×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৬-১৮
  • ৩৫৭ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ সন্ধ্যার পর, বুয়েটের মাঠে জমায়েত হয়েছে জাসদ’র তাত্ত্বিক এবং স্রষ্টা সিরাজুল আলম খান, আরও রয়েছেন মাহমুদুর রহমান মান্না, আ ফ ম মাহবুবুল হক। মান্নার ভাষায়, ‘তখন হঠাৎ ইনু (হাসানুল হক ইনু) এসে হাজির। ইনু ভাইকে দেখে সিরাজ ভাই তো সাংঘাতিক উচ্ছ্বসিত-‘ইনু চলে এসেছে, আমার কোনো কিছু লাগবে না।’

এরই কয়েক ঘণ্টা আগে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাসদ ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা করে। জনসভা শেষে একটি জঙ্গি মিছিল মিন্টো রোডের দিকে যায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসা ঘেরাও করে। সেখানে রক্ষীবাহিনী গুলি চালালে অনেকেই হতাহত হন। ‘আমরা তো তখন মনমরা, এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে, জাফর মারা গেছে। শুনেছি আরও চার-পাঁচজন মারা গেছে। আমরা সবাই আমাদের বিমর্ষতাই ব্যাখ্যা করছি।’ সিরাজ ভাই বললেন, ‘আমি তোমাদের কারও সঙ্গেই একমত নই। আমি মনে করি বাংলাদেশে প্রথম একটা বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ঘটল।’

‘এ কথা শুনে আমরা চাঙা হয়ে গেলাম। সিরাজ ভাই তো আমাদের কাছে ডেমি-গড। আমরা ভাবছি বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। আর উনি বলছেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। এত বড় বিপ্লবী কর্মকাণ্ড করে ফেলেছি, বুঝতে পারিনি। এজন্য লজ্জিত আমরা (প্রতিনায়ক, মহিউদ্দিন আহমেদ পৃ. ৩০২)।’

১৯৬৩ সালের ছাত্রলীগের সম্মেলনে কেএম ওবায়দুর রহমান সভাপতি, সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক এবং আবদুর রাজ্জাক সহসম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালের প্রথমার্ধে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে নিয়ে সিরাজুল আলম খানকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কঠোর পরিশ্রমী, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং মেধাবী হওয়ার কারণে তিনি খুব দ্রুত বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত কর্মীতে পরিণত হতে সমর্থ হন।

সিরাজুল আলম খান ১৯৬৩-৬৫ সালে জেলে ছিলেন, ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগের সম্মেলন করে ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক পদ থেকে সরে আসেন। ৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। সাংগঠনিক পদ থেকে সরে এলেও তিনি সারা দেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নিজস্ব প্রভাব-বলয় আরও বিস্তার এবং সুসংহত করেন।

৭০-এর দশকের কিউবা ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ তার ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান, সমতল ভূমির দেশের জন্য সমাজতন্ত্রী ভাবধারার এ ধরনের সশস্ত্র যুদ্ধ কতটা বাস্তবসম্মত, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মতো একটি বড় এবং সুপ্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট সমরাস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ কোথা থেকে আসবে বা কে দেবে সেই বাস্তবতা বিবেচনা না করে তিনি তার অনুগত প্রভাব-বলয়ের মধ্যে সমাজতন্ত্রী ভাবধারা প্রচার করেন, ৭০-এর নির্বাচনের বিরোধিতা এবং সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার ধারণা দেন।

সিরাজুল আলম খানের সমাজতন্ত্রী ভাবধারা এবং নির্বাচনের পরিবর্তে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দ্রুত স্বাধীনতা অর্জনের ধারণার প্রতি অনুগত এবং বিশ্বস্ত সেই কর্মী বাহিনীকে কাজী আরেফ ‘নিউক্লিয়াস’ নাম দেন। সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য অনুযায়ী ‘১৯৬৮ সালের আন্দোলনের আগ মূহূর্ত অবধি ‘নিউক্লিয়াস’র সদস্য সংখ্যা বেড়ে ১২০০-তে দাঁড়ায়।‘ (আমি সিরাজুল আলম খান : একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য, পৃ. ৫৩)। ‘বাংগালির জাতীয় রাষ্ট্র’ গ্রন্থের ৭৬ পৃষ্ঠায় কাজী আরেফ লিখেছেন, ‘আমরাই ৬৪ থেকে ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে সশস্ত্র গেরিলা ট্রেনিং ও অস্ত্র সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করি।’

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি বাহিনী নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, তখন কাজী আরেফদের এই ১২০০ প্রশিক্ষিত বাহিনীর ন্যূনতম সশস্ত্র প্রতিরোধের কোনো প্রমাণ আমরা দেখতে পাই না। অথচ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে শিকারের বন্দুক দিয়ে একাই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে ২৫ মার্চে প্রথম শহিদ হয়েছিলেন সেই সময়কার ধানমন্ডির অতি পরিচিত মুখ, ধানমন্ডি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক খোকন ভাই। ২৫ মার্চ রাতে ৩২ নম্বরের লেকের উলটা পাশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গুলি চালালে, পাকিস্তানিদের গোলায় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং শাহাদতবরণ করেন (আবাহনীর সাবেক খেলোয়াড় জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ এবং তার ভাইদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য)।

১৯৭০ সালে প্রথম ছাত্রদের সরাসরি ভোটে ডাকসুর প্রতিনিধি নির্বাচন হয়। তখন শেখ শহীদ এবং রবের মধ্যে ভিপি পদের মনোনয়ন নিয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বেশ টানাপোড়েন শুরু হয়। শেখ মনির সমর্থকদের পছন্দের প্রার্থী শেখ শহীদ ভিপি নির্বাচিত হলে সিরাজুল আলম খানের উদ্দেশ্য পূরণ হতো না। সিরাজুল আলম খানের পছন্দের রব ভিপি প্রার্থী হন এবং মাত্র ৮৬ ভোটে জয়লাভ করেন।

ডাকসু নির্বাচনের সময়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে দুটি বিপরীত ধারার অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি রব-শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে হঠকারী অংশ, যারা ৭০-এর আসন্ন সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে অনতিবিলম্বে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে, বিপরীতে নূরে আলম সিদ্দিকী-মাখনের নেতৃত্বাধীন অংশ, যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভোটের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে প্রথমে ছয় দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন এবং পরে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে ছিলেন।

’৭০-এ ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকি তার ‘একাত্তরের অজানা অধ্যায় : এক খলিফার বয়ান’ গ্রন্থের ৭৯ পৃষ্ঠায় ৭০ সালে পল্টনের এক বিশাল জনসভার কথা বর্ণনায় বলেছেন যে, পল্টন ময়দানে ছড়ানো-ছিটানো সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস’র সমর্থকরা গগনবিদারি স্লোগান দিতে লাগলেন-নির্বাচন-নির্বাচন, বর্জন-বর্জন; ইত্যাদি। সবশেষে সভাপতির ভাষণে নূরে আলম সিদ্দিকী নির্বাচনের অংশগ্রহণের পক্ষে যুক্তি দিয়ে যখন ভাষণ শেষ করলেন, তখন পুরো পল্টন ময়দানের উচ্চকিত আওয়াজ-শেখ মুজিবের গর্জন, সত্তরের নির্বাচন।

ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতির ছয় দফা দাবি অর্জনের রাজনৈতিক, আইনগত ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সারা দেশের মানুষ সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্সে স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক দেন, তখন সিরাজুল আলম খান এবং তার অনুসারীরা সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিতে থাকেন। সিরাজুল আলম খানের চাপে বঙ্গবন্ধু সেদিন হঠকারীভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে যে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সামনে লাখো মানুষ শুধু ‘কামানের খোরাকে’ পরিণত হতো তা পরে ‘রংপুর ক্যান্টনমেন্ট দখলের হঠকারী প্রচেষ্টা এবং তার মর্মান্তিক পরিণতি আমার যুক্তির বাস্তবতা প্রমাণ করে (রংপুর সেনানিবাসে দুঃসাহসিক আক্রমণ, কাজী সাজ্জাদ আলি জহির; এবং যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা, মেজর নাসিরউদ্দীন)।

২৫ মার্চ প্রতিরোধ গড়তে না পারলেও প্রবাসী সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীতে যোগ না দিয়ে সমান্তরালভাবে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ তাদের অনুগত কর্মী বাহিনীকে নিয়ে গড়ে তোলেন মুজিব বাহিনী। মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার ফলে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকার প্রচণ্ড বিব্রত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে নানা রকম শঙ্কার সৃষ্টি হয়। শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ এই মুজিব বাহিনীর যৌথ নেতৃত্বে থাকলেও এর প্রশিক্ষকদের ৮০-৮৫ ভাগ ছিল সিরাজুল আলম খানের একান্ত অনুগত প্রভাব-বলয়ের (নিউক্লিয়াস) সদস্য।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের পুরোনো দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু এবার শেখ ফজলুল হক মনি সমর্থিত নূরে আলম সিদ্দিকী-আবদুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বাধীন অংশের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলে ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়। তখন এ নিউক্লিয়াস’র সদস্যদের নিয়ে সিরাজুল আলম খান প্রথমে জুলাইয়ে ছাত্রলীগকে বিভক্ত করেন এবং পরে অক্টোবরে জাসদ এবং পরে গণবাহিনী তৈরি করেন।

সিরাজুল আলম খান ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় সারা দেশে ছয় দফা প্রচার এবং এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার বিষয়ে অত্যন্ত সফল সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সিরাজুল আলম খান কঠোর পরিশ্রমী, মেধাবী ছাত্র এবং সম্মোহনকারী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, যে নিজের মেধা এবং ক্ষমতাকে বরাবরই অতিমূল্যায়ন করতেন, যার প্রকাশ নিজের বক্তব্যেই রয়েছে। ‘ছাত্র হিসাবে আমি খুব মেধাবী ছিলাম। ভাবতাম মেট্রিকে প্রথম স্থান অধিকার করব। শিক্ষকরাও তাই মনে করতেন। পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর দেখলাম আমার স্থান দশের মধ্যেও নেই। আমার স্থান ছিল ১৮তম (আমি সিরাজুল আলম খান, একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য, শামসুদ্দিন পেয়ারা)। শুধু পড়াশোনায় নয়, রাজনৈতিক জীবনেও তিনি সব সময় নিজেকে অতিমূল্যায়ন করতেন।

স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যেই হিটলারের ন্যাশনালিস্ট সোশ্যালিস্ট পার্টির বাংলা অনুবাদ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেন তিনি। সেই দলের জন্য প্রস্তুত করেন নতুন তত্ত্ব ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’! সদ্য স্বাধীন দেশ হয়ে ওঠে অস্থির, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘটে মারাত্মক অবনতি। সেই সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধীরা মিশে যায় জাসদের মিছিলে।

সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার আগে যতদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনামতো চলেছিলেন, ততদিন সফল সংগঠক হিসাবে দেশের জন্য অনেক অবদান রাখতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার পর যখনই নিজের বুদ্ধিতে চলতে গিয়েছেন, তখনই দল এবং দেশের জন্য বিপর্যয় ঘটিয়েছেন। জাসদ’র কর্মকাণ্ডে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে পড়ে বিভক্ত-অস্থির। সেই অবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা সম্ভব হয়।

লেখকঃ অধ্যাপক নাজমুল আহসান শেখ : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat