×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০২-২৮
  • ২৫৫ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

এমন একটা সময় ছিল যখন উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সশস্ত্রবাহিনী ভারতে বিক্ষোভ চালিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে তাদের আস্তানায় আশ্রয় নিত। কিন্তু ভারতের হাতে কোনো কিছু করার ছিল না। এমনও সময় ছিল, যখন সীমান্তে দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বহু মানুষ মারা যেত। আর তাদের নির্মমভাবে পশুর মতো হাত-পা বেঁধে বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হতো। আবার এমনও সময় গেছে, যখন বাংলাদেশি ভিসা পাওয়া খুব কঠিন ছিল।

কিন্তু এ সবই ছিল ২০০৯ সালের আগের ঘটনা। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন মনে হয়,  এগুলো সবই ছিল দুঃস্বপ্ন। ভারত এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতে পারে, উলফা ক্যাম্প এখন অনেক দূরের এক স্মৃতি; সীমান্তে গুলি চালানোর কথা এখন কেউ কেউ শুনে থাকলেও তা হয় নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর। এখন দুই দেশের মানুষই বিশ্বাস করেন যে, কূটনীতিকরা এখন দুদেশের জনগণের মেলবন্ধনের জন্য কাজ করছেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে, দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে। দুটি দেশ তাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো প্রসারিত করেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ তার ভূরাজনৈতিক নৈকট্য এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য ভারতের সবচেয়ে মূল্যবান প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে, যা দেশটিকে দক্ষিণ এশীয় সংযোগ ও বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করেছে।

১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের সামরিক সরকার তাদের বৈদেশিক নীতির অবস্থান পরিবর্তন করায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। সেই সময় থেকেই ভারত সবসময় বাংলাদেশকে নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। দুই দেশ বছরের পর বছর ধরে একে অন্যকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে এবং ভবিষ্যতেও এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং নেইবারহুড ফার্স্ট (প্রতিবেশী প্রথম) প্রোগ্রামের একটি মৌলিক নীতি। গত কয়েক বছরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বেশিরভাগ ভারতীয়কে বাংলাদেশের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তর আসবে: ‘শেখ হাসিনা সরকার আমাদের বন্ধু।’ আসলেই তাই। বাংলাদেশ ভারতের জন্য অনেক অবদান রেখেছে। ইসলামাবাদে সার্কের বৈঠকে বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা ইস্যু ‍তুলে ধরেছে এবং ভারতও সে সময় বাংলাদেশকেই অনুসরণ করেছে। ২০১৬ সালে ঢাকায় হলি আর্টিজেনে সন্ত্রাসী হামলার পর শেখ হাসিনা বলেছেন,  রমজান মাসে এ ধরনের সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য। সে সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমাকে দেখেন। সন্ত্রাসীরা আমার বাবা, মা ও ভাইকে হত্যা করেছে। টাকা থেকে কী লাভ?’ এছাড়াও তিনি সে সময় আরও বলেন, ‘আপনারা কেন অং সান সুচিকে নিয়ে এত সমালোচনা করেন? তিনি অনেক কিছু সহ্য করেছেন। এমনকি তিনি জেলেও আছেন। তার স্বামী যখন মারা যান, তিনি তাকে দেখতেও যেতে পারেননি। আমি মানুষকে আরও বেশি সহানুভূতিশীর হতে বলি সব সময়।’

শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও বেশি উন্নয়ন করেছেন। ছিটমহল সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। শুধু তিস্তার সমস্যা সমাধান হয়নি; যা দুই পক্ষই খুব ভালো করে জানে যে কী কারণে হয়নি। এছাড়াও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার মধ্যে অনেক ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

২০১৫ সালের ৬ জুন দুটি দেশের মধ্যে উপকূলীয় নৌপরিবহন সংক্রান্ত একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়।  উপকূলীয় শিপিং চুক্তির লক্ষ্য ছিল: উভয় পক্ষের পারস্পরিক সুবিধার জন্য বাণিজ্যিক সামুদ্রিক কার্যকলাপ সহজতর করা। এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে সামুদ্রিক সংযোগের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রধান উপাদান নিরাপত্তা সহযোগিতা। বাংলাদেশ ভারতের বিভিন্ন সরকারবিরোধী সংগঠনের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। এ ছাড়াও গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বজায় রেখেছে বাংলাদেশ।

ভৌগোলিকভাবে অনগ্রসর উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভারতের নিকটতম অংশীদার হিসেবে দেখা হয়। দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার ও স্থানান্তরের মাধ্যমে ভারতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছে শেখ হাসিনা সরকার। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ছয়জনেরও বেশি উলফা নেতাকে হস্তান্তর করেছে।

সম্প্রতি ভারতের একটি বিশাল অস্ত্রাগার উদ্ধার করেছে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী এবং এর পাশাপাশি অস্ত্র চোরাচালান মামলার বিচারও করা হয়। এর মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন দেখা গেছে।

এ ছাড়াও বেশ কয়েকটি সংযোগ প্রকল্প অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ; যার সব কটিই উত্তর-পূর্ব ভারতকে সুস্পষ্টভাবে উপকৃত করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প উত্তর-পূর্বের জন্য ট্রানজিট বিকল্প, ভুটান, ভারত ও নেপালের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক সড়ক সংযোগ এবং চীন, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তঃ আঞ্চলিক সংযোগ।

এ ছাড়াও বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা ইন্টারনেট এবং বিদ্যুৎ বিনিময় করেছে। ২০১৬ সালের মার্চে ত্রিপুরা বাংলাদেশে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানি শুরু করে। আর বাংলাদেশ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ বিস্তৃত করতে ত্রিপুরার সঙ্গে ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ শেয়ার করেছে।

বাংলাদেশ ভারতের জন্য চতুর্থ বৃহত্তম রেমিটেন্স উৎস। ২০১৭  সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ  থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আয় করেছে ভারত। ভারতীয় শ্রমিকরা বেশির ভাগই বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কর্মরত। তারা মার্চেন্ডাইজিং এবং ক্রেতা হ্যান্ডলিংয়ের মতো বিষয়গুলো দেখে থাকেন। সীমান্ত হাট উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ছিটমহল বিনিময় কর্মসূচি এবং সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উভয় দেশের সীমান্ত ও নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে সহায়তা করেছে।

ভূরাজনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণ করেছে। চীন ও ভারত উভয়ই অন্যান্য দেশকে তাদের দিকে ঝুঁকতে আগ্রহী। বিশেষ করে, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযোগের জন্য চীনের দৃঢ় প্রচেষ্টার একটি উদাহরণ। দেশটির সামরিক বাহিনী চীনা অস্ত্রের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সবসময় তার নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের প্রতি অনুগত থেকেছে। এই ভূরাজনৈতিক খেলায় বরং নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে পয়েন্ট তৈরি করেছে। যাইহোক, কেউ যুক্তি দিতে পারে যে ধাক্কা দিলে দেশটি ভারতের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য।

যদিও দুই দেশের মধ্যে সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে বিরোধ প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টি করে, তবুও অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই বাংলাদেশ ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নয়াদিল্লির উচিত ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আদর্শের ওপর ভিত্তি করে একটি পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা, যাতে নিশ্চিত করা হয় যে এই এলাকায় তার এক বিশ্বস্ত মিত্র কখনোই বিচ্ছিন্ন না হয় এবং বাংলাদেশ যে প্রশ্নাতীত সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় তা স্বীকার করে। এর জন্য তাদের ঢাকার স্বার্থকে বিপন্ন করতে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং জরুরি সমস্য মোকাবিলায় সহায়তা করতে হবে যেন বোঝা যায় তারা তাদের নিকটতম প্রতিবেশীকে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

২০১২ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর একটি অনুলিপি দেখান এক প্রথিতযশা সাংবাদিককে। অনুলিপিটি সে সময় দিল্লিতে ছিল। সেটিতে শেখ হাসিনার স্বাক্ষরসহ লেখা ছিল ‘দাদা-বৌদির কাছে’। প্রণব মুখার্জি বলেন, ‘শেখ হাসিনার ছেলে জয় এটাকে এখানে (দিল্লি) নিয়ে এসেছে।’ অর্থাৎ শেখ হাসিনা প্রণব মুখার্জিকে দাদা বা বড় ভাই বলে ডাকতেন।

 

এরপর প্রণব মুখার্জি যখন লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হন তখন তাকে ফোন করে অভিনন্দন জানান শেখ হাসিনা। সে সময় প্রণব মুখার্জি বলেন, ‘তুমি কিন্তু প্রটোকল ভাঙ্গছো।’ উত্তরে হাসিনা বলেন, ‘প্রটোকল রাখেন!’

এখন বহু মানুষ শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করে। আর ভারতের অনেক মানুষই তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে চায়। আরও বহুদূর তাকে যেতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat