×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০১-২৮
  • ২৫৮ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত নিগূঢ়-তাৎপর্যপূর্ণ।  বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন এতটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে; যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল হিসেবে প্রতিভাত। বিশেষ করে উন্নয়ন অগ্রগতিতে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা-মেধা-দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঊর্ধ্বে সমাসীন।

অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কতিপয় কর্তৃত্ব-আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বেড়াজালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে উক্ত রাষ্ট্রসমূহের কদর্য ভূমিকা নিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত অসন্তুষ্টির বার্তা দিয়েছে। যেটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অটুট বন্ধনকে আরও অধিকমাত্রায় মর্যাদাসীন করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত কূটনৈতিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‘ঢাকায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হোক এটা ওয়াশিংটনের মতো ভারতও চায়। কিন্তু যেভাবে বর্তমান সরকারকে অস্থির করার জন্য আমেরিকার পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে, তা প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক নয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার দুর্বল হলে তা ভারত এবং আমেরিকা কারও পক্ষেই সুখকর হবে না বলে মনে করে ভারত।’

মূলত স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে।  বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৫ সালে এ বিষয়ে স্বাক্ষর হওয়া নতুন চুক্তির আওতায় রয়েছ দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরও কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি।  ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় এবং সহযোগিতার নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়।  উক্ত সফরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি বন্ধুত্ব-শান্তি-সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু গঙ্গা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদীর সুষম পানি বণ্টন ও ছিটমহল হস্তান্তরের প্রশ্ন উত্থাপন করেন। ১৯৭৪ সালে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল ও সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় কিছু অতিরিক্ত ভূমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ও শক্তিশালী ভূমিকার জন্য ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ফারাক্কা বাঁধসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে ভারত ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করবে এবং বাংলাদেশ পাবে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি। যেটির ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকারের জয়লাভের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে নবতর অধ্যায় রচিত হয়। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। দুই দেশ দ্বিপক্ষীয়-আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বহু বিষয়ে মতৈক্য পোষণের প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবিরোধী এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। উল্লেখ্য, সফরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখন্ডের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রানজিট সুবিধা, ভারতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা, সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সম্মত, বাংলাদেশ কর্তৃক ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং ভারত কর্তৃক এক মিলিয়ন ডলার ঋণদান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মেলবন্ধন সুদৃঢ় হয়।  ২০১৪ সালে শ্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ এবং শপথবাক্য পাঠের অনুষ্ঠানে অন্যতম আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।  একই বছরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশে তার প্রথম আন্তর্জাতিক সফর করে সম্পর্ক উন্নয়নে ভিসা, বিদ্যুৎ, মৈত্রী এক্সপ্রেস, বাস চলাচলসহ ৬টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ২০১৫ সালের জুনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিগুলোর মধ্যে ২০০ কোটি টাকার ঋণ-বিষয়ক সমঝোতা, ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ ঘোষণা, ৩ হাজার মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ, ১৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ রয়েছে সামুদ্রিক নিরাপত্তা সহযোগিতা, মানব পাচার ও জাল মুদ্রা রোধ।  আবার ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৬৮ বছরের স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান দুই দেশের সম্পর্কের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। ২০১৮ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’।

২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে ৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং ৩টি প্রকল্পের উদ্বোধন হয়। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুই দেশের সরকার প্রধানদের এক ভার্চুয়ালি বৈঠকে জ্বালানি, সামাজিক উন্নয়ন, কৃষিসহ ৭টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্বাক্ষর হয়।  ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের মাধ্যমেও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে উঁচুমাত্রিকতার সেতুবন্ধ নির্মিত হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এই সফরটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্ব-তাৎপর্যপূর্ণ।  সফরকালীন সময় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ইস্যু, জ্বালানি, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি দুই দেশের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পায়। স্বাক্ষরিত হয় সাতটি সমঝোতা স্মারক।

সমঝোতা স্মারকের মধ্যে ছিল- সুরমা ও কুশিয়ারা প্রকল্পের অধীনে কুশিয়ারা নদী থেকে বাংলাদেশ কর্তৃক ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার, ভারতের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (সিএসআইআর) সঙ্গে বাংলাদেশের সিএসআইআরের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ভারতের ভোপালে অবস্থিত ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমির মধ্যে সমঝোতা স্মারক, ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম ‘প্রসার ভারতী’র সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মধ্যে সমঝোতা, মহাশূন্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা, ভারতের রেলওয়ের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যপ্রযুক্তিগত সহযোগিতা অন্যতম।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ ভারতীয় সেনা পরিবারের সদস্যকে বাংলাদেশের সম্মাননা এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ-যুদ্ধাহত ভারতীয় সৈনিকদের পরিবারের সন্তানদের ‘মুজিব স্কলারশিপ’ প্রদান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী-স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী যৌথভাবে উদযাপন দুই দেশের সম্পর্ককে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দুই দেশের উন্নয়ন-নিরাপত্তায় অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে এ সম্পর্ক পারস্পরিক আস্থা-শ্রদ্ধা-সম্মান ও ভালোবাসায় গভীর থেকে গভীর হোক।

যেকোনো অশুভ-অন্ধারের শক্তির চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র দুই দেশের চির অটুট এই বন্ধনে চিড় ধরাতে না পারে, সেদিকে রাষ্ট্র-সরকারসহ আপামর জনগণের মনোযোগ নিবিষ্ট করা একান্ত জরুরি। বিরাজিত রাজনীতি-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষা ও সামাজিক সকল অসঙ্গতিগুলোকে পর্যাপ্ত আলাপ আলোচনার মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণে যথাযোগ্য মর্যাদায় যৌক্তিক সমাধান অবশ্যই সম্পর্ককে আকাশচুম্বী উচ্চতায় নিয়ে যাবে- নিঃসন্দেহে তা প্রত্যাশিত।

লেখক--হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat