"হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় দর্শন আলাদা, তাদের
সামাজিক আচার আচরণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভিন্ন। হিন্দু ও
মুসলিমদের একই জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত করা একটা স্বপ্নমাত্র।‘’
মোহাম্মদ
আলী জিন্নাহর এই চিন্তা চেতনার ভিত্তিতেই ''দ্বি-জাতি
তত্ত্বের"একটা ভ্রান্ত আদর্শে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হয়। দেশভাগের মাত্র পাঁচ
বছরের মাথায় জিন্নাহর কথাকে ভুল প্রমাণিত করে বাঙালিরা। হিন্দু-মুসলিম যে একই
জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে তার প্রথম প্রমাণ বাঙালিরা দেয় ৫২’র ভাষা আন্দোলনে। পরবর্তীতে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই পূর্ব
পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী একক জাতীয় পরিচয় হিসেবে আন্দোলন করেছে, হিন্দু-মুসলিম নামক আলাদা ধর্মীয় বেড়াজালে কোন আন্দোলন তারা করেন নি।
দ্বি-জাতি তত্ত্ব যে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর একটা ভাঁওতাবাজি ছিলো তা খুব দ্রুতই
সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে। মুসলমানদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি
তাঁর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই
দীর্ঘ ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির হাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরাই
সবচাইতে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন। সাতচল্লিশ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের ওপর
পশ্চিমাংশের কর্তৃত্বের ইতিহাস সবারই জানা। একের পর এক বাঙালিদের সংগ্রাম, বিশেষত ১৯৬৬ সালের পর শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে
পরিচালিত আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে যাওয়া ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার।
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর হাতে একাত্তরের গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালিদের
প্রত্যক্ষ জাতিগত নিপীড়নের চূড়ান্ত রূপটি যখন মঞ্চস্থ হলো তারপর পুরোদমে শুরু হলো
বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন। এদিকে একাত্তরের বর্বর গণহত্যার পর বাংলাদেশের
স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকা নির্ধারক হয়ে দেখা দেয়।
একাত্তরের
ঘটনাবলি ভারতের সামনেও আঞ্চলিক আধিপত্য সংহত করার বিরাট সুযোগ এনে দেয়। ১৯৭১ সালে
পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ভারতের সাধারণ
নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোট পেয়ে ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী
নির্বাচিত হন ৷ শপথ গ্রহণের আগেই এই উপমহাদেশের ভয়াবহ গণহত্যা প্রত্যক্ষ করতে হয়
ইন্দিরা গান্ধীকে। রক্তের হোলিখেলার মাঝে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হয়নি কোন
পক্ষে যাবেন তিনি। একটি উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হিসেবে
ইন্দিরা গান্ধী দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেন এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান।
মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে গোটা বিশ্বে আমাদের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
একাত্তরের
২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা
মৃত্যু ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। স্বভাবতই মানুষ এমন আবহ থেকে পালাতে চেয়েছে।
এ ক্ষেত্রে ভারতই হয়ে ওঠে আশ্রয়স্থল। এর পেছনে ভারতের গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার
প্রতি আবেগ বা উৎসাহের ভূমিকা যতটা না ছিল, তার চেয়ে মুখ্য ছিল ভৌগোলিক
নৈকট্য। এপ্রিল নাগাদ প্রায় তিন লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।
প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজার মানুষ শরণার্থী হতে শুরু করে। ফলে গুণগতভাবে একদম ভিন্ন
পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এ সংকট তখন বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ
কাজে ভারত কালবিলম্ব করেনি।
ভারতের
প্রথম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় ২৬ মার্চ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং তাঁর সরকারের
উদ্বেগের কথা জানান। পরদিন ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বাংলাদেশের পরিস্থিতি
নিয়ে বিতর্ক হয়। রাজ্যসভায় এক বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি
মোকাবিলার কথা বলেন। ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে পূর্ণ সমর্থন দেন। শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য
সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়। পশ্চিমবাংলা, বিহার, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সীমান্তে শরণার্থী শিবির
খোলা হয়। ভারত দক্ষ হাতে শরণার্থী সমস্যারও একটা ব্যবস্থাপনা করেছিল। বাংলাদেশের
কেউ ভারতে পৌঁছালে খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তা মিলত। জুন মাস
নাগাদ প্রতিদিন এক লাখ করে মানুষ ভারতে শরণার্থী হতে থাকে। ভারতের অর্থনীতিতে এর
প্রচণ্ড চাপ পড়ে। অর্থনীতির দুর্বলতা সত্ত্বেও ভারতের আচরণ ছিল হূদ্যতাপূর্ণ।
ভারত
সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের শুধু আশ্রয় ও লালন পালনের দায়িত্ব পালন করেই যে চুপ
ছিল তা কিন্তু নয়। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার সরকারদের স্ব স্ব স্থানে রিফিউজি ক্যাম্প এবং গেরিলা
ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দশ দেয়। নির্বাসিত বাংলাদেশি সেনা
অফিসার ও স্বেচ্ছাসেবীরা ওইসব ক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংগ্রহ ও
প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত হয়। রিফিউজির পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের রিক্রুট করে
নিয়ে এসে ট্রেনিং দেওয়া হয় । সবাই পায় গেরিলা প্রশিক্ষণ, ঘুরে
দাঁড়ায় বাঙালি, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ পেয়ে তারা
সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করতো এবং একের পর এক অপারেশন চালাতো।
ভারত
সরকার বিএসএফকে আনঅফিশিয়ালি নির্দেশ দেয়, বাংলাদেশী গেরিলা
মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিসংগ্রামে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতে এবং তাদেরকে এ ব্যাপারে
পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়, সেই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে
কমান্ডো রেইড/ডেমোলিশনে দক্ষ ১০০ জন ব্যক্তি এবং কতিপয় অফিসার নিয়ে বিএসএফ কমান্ডো
বাহিনী গঠন করে, যারা পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে
মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেই পাকিস্তান বাহিনীর ওপর অতর্কিতে হামলা চালাতো এবং পাকিস্তান
হানাদার বাহিনীর কার্যক্রমকে শ্লথ ও নস্যাত করে দিতো। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের
মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, বেসরকারিভাবে
ভারত এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশে জড়িয়ে যায়, যদিও
আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা ঘটে অনেক পরে। তিনি জানান, এপ্রিল থেকেই
ভারত মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দিতে শুরু করে। জেনারেল জ্যাকব আরো বলেন, এটা ছিল বাংলাদেশের ফাইট, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও
মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে ভালোবেসে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, আমরা
পাশে ছিলাম। ইন্দিরা গান্ধী ও জেনারেল জ্যাকবের মন্তব্য থেকে বাংলাদেশের
মুক্তিসংগ্রামে ভারত কীভাবে জড়িয়ে পড়ে এর আঁচ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের
নির্বাসিত সরকার এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—যেমন
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, মুক্তিবাহিনী ইত্যাদি গড়ে
তুলতে ভারত ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে বাংলাদেশের
অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারের কার্যক্রম শুরু হয় বাংলাদেশ-ভারত
সীমান্তের কাছে বৈদ্যনাথতলায়। পাকিস্তানি বাহিনীর চাপে শিগগির প্রবাসী সরকার ভারতে
সরে যেতে বাধ্য হয়। তখন কলকাতায় স্থাপন করা হয় এর প্রধান কেন্দ্র। অস্থায়ী সরকারের
ব্যয়ের বড় অংশই বহন করে ভারত। এর ফলে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ
কেন্দ্রগুলোতে অনেক অবাধে ও ব্যাপক মাত্রায় প্রচারণা চালানো সহজ হয়।
স্বাধীন
বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায়ও ভারত সহায়তা করে। কলকাতা রেডিও
স্টেশনের একটি তলায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জায়গা করে দেওয়া হয়। এর
কার্যক্রম শুরু হয় জুন মাসে, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। ভারতের ট্রান্সমিশন
নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে এ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা সম্ভব হয়।
মুক্তিযুদ্ধ
বা স্বাধীনতার সংগ্রাম বিফলে পর্যবসিত হয় যদি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় না করা যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল ভারতের পক্ষে সোভিয়েত
রাশিয়ার সরাসরি সমর্থন প্রদান। ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত রাশিয়া সফর করে তাদের সঙ্গে
২২ বছরের শান্তি চুক্তি করেন, সেই চুক্তির জের টেনে চমৎকার কূটনৈতিক
দক্ষতায় বাংলাদেশ ও তার স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তিনি সোভিয়েত সরকারকে
বোঝাতে সমর্থ হন যে, ভারতের মতই বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবে একটি
সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। পৃথিবীর সেসময়ের শীর্ষশক্তি সোভিয়েত
সরকার ইন্দিরা গান্ধীর বুদ্ধিদীপ্ত কূটনৈতিক দাবিকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি,
এখানেই ইন্দিরা গান্ধী তার বুদ্ধি দিয়ে পুরো যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন
। রুশ ছত্রছায়ার ফলেই ভারত চীনের হুমকি থেকে মুক্ত হয়ে আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে সামরিক
সাহায্য দেওয়া শুরু করেন। রাশিয়ার এই সমর্থন আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে বিশ্ব
পরিমন্ডলে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো, আর তা সম্ভব
হয়েছিলো ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমেই।
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরকারের কূটনৈতিক বিচক্ষণতা ছিলো অসাধারণ। এক্ষেত্রে একটি
ঘটনা উল্লেখ করা দরকার। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সাল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
আহমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার গঠন হয়, ১৭
এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়। এর আগে ২৭ মার্চ ভারতের
লোকসভা ও রাজ্যসভায় এক প্রস্তাবে অবিলম্বে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন
বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। এরপর ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি
দেওয়ার দাবি জানায়। কিন্তু ভারত সরকার ও সরকারপ্রধান ইন্দিরা গান্ধী তখন বিচক্ষণতার
সঙ্গে ধীরে চলো নীতি ও কূটনৈতিক কৌশলের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ১৩ এপ্রিল
বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘পূর্ববাংলায় যা ঘটেছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকবে না।’ মুক্তিযোদ্ধাদের
প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি
ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করেন। পরে ১৭ মে ইন্দিরা গান্ধী যান পশ্চিমবঙ্গে। সবচেয়ে বেশি
শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল সেখানেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে এই বলে আশ্বস্ত করেন, শরণার্থী
বিষয়ে কেন্দ্র তাদের পাশে আছে ও থাকবে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে
শরণার্থী আশ্রয় নেয় প্রায় ১ কোটি। ভারতীয় কমান্ডারদের প্রতি ইন্দিরার আদেশ ছিল,
‘আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানি কামানগুলো নিস্তব্ধ না হওয়া
পর্যন্ত আপনাদের অভিযান চলবে।’
আন্তর্জাতিকভাবে
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে সমর্থন দেবার পক্ষে জোরালো পদক্ষেপ নেবার পাশাপাশি
অস্থায়ী সরকারকে ভারতের অভ্যন্তরে স্থান দেন। সর্বোপরি শরণার্থীদের সহায়তার
পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী গঠনে সার্বিক সহায়তা দিয়েছে ভারত সরকার। বাংলাদেশের লাখ লাখ
শরণার্থীকে সেবাযত্ন করায় ইন্দিরা গান্ধীর এ কাজকে যীশু খৃষ্টের কাজের সঙ্গে তুলনা
করেছেন নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা।
ভুটানের
পর ভারতের পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি
দেয়ার সাথে সাথেই একদিকে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সব ধরণের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন
করে,
অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সকল ধরণের সাহায্য সহযোগিতা
বন্ধের ঘোষণা দেয়। এই প্রতিকূল অবস্হাতে থেকেও সময়োপযোগী সাহসী সিদ্ধান্তে অটল
থাকা এবং বাংলাদেশকে আকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ তত্কালীন ইন্দিরা
গান্ধী সরকার ভারতীয় জনগণকে চিরজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
এদিকে
পাকিস্তান তার শেষ অস্ত্র হিসেবে ৩ ডিসেম্বর ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
উদ্দেশ্য,
এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক দরবারে নিয়ে গিয়ে ভারতকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য
করা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মতামত গঠনে ভারত সফল হওয়ায়, বিশেষত
জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন থাকায়, ভারতীয় বাহিনী
মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় অত্যন্ত দ্রুত বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানের যুদ্ধের
পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে যায়। এককভাবে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে হারানো
পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে ভারতীয় বাহিনী দ্রুতবেগে ঢাকার দিকে যাত্রা করে।
পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা অবশ্য তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ তৈরি করে দেয়।
পাক-ভারত
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতের নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি
বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য ‘চূড়ান্ত বিবৃতি’ পাঠায়।
পাকিস্তানি সেনারা ১৬ ডিসেম্বর এই যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
বাংলাদেশের
পক্ষে কাজ করাতে ভারত সরকারকে অনেক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে হয়েছে।
নিক্সন-কিসিঞ্জারের হুমকি ও রূঢ় আচরণের মুখেও ভারত ছিল অনড়। একটি তথ্য হয়তো আমার
জানিনা,
১৯৭১ সালে ভারত প্রায় এক কোটির উপর শরণার্থীকে ভরণ পোষণ এবং আশ্রয়
দেয়ার পর ভারতে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তা কাটিয়ে উঠার জন্য ভারত সরকার
একাত্তরের পর প্রায় বিশ বছর তাঁর নিজ দেশের সরকারি কর্মচারি-কর্মকর্তাদের বেতন
থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ কেটে নেয়। এই তথ্য জানার পর একটা প্রশ্ন অজান্তেই এসে যায়,
ইন্দিরা গান্ধী যদি তখন প্রধানমন্ত্রী না থাকতেন তবে কতো সময় লাগতো
এই স্বাধীনতা অর্জনের? সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। আমরা
হয়তো জানিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিহত ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা কতো!
মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ঠিক কত সৈন্য নিহত হয়েছিলেন, বাঙালি
তা আজো জানে না। এনডিটিভি জানাচ্ছে, সংখ্যাটি ৩৯০০, আহত ৯৮৫১। ইকোনমিক টাইমস/ ইন্ডিয়া টাইমস ২ জুন ২০১৫ বাংলাদেশ সরকারের বরাত
দিয়ে জানাচ্ছে, নিহতের সংখ্যা ১৯৮০।
বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অনন্য ভূমিকার ইতিহাসকে খাটো করে দেখার অপপ্রয়াস অনেকের
মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ সমগ্র ভারতবাসী, ইন্দিরা গান্ধী তথা ভারত
সরকার এবং বিএসএফ ও ভারতীয় সৈন্যদের কিংবদন্তি সাহায্য-সহযোগিতা ও আত্মত্যাগের সফল
পরিণতি বাংলাদেশ। এই কথাটা আমরা অনেকেই স্বীকার করতে চাইনা। আমরা অনেকেই ভারতের
সামরিক কৌশলগত স্বার্থকে সামনে আনি, কিন্তু একবারো ভাবিনা
বাংলাদেশের জন্য ভারতবাসীর এতটা ত্যাগ ও ভালোবাসা এতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনাকে অপমান করা হয়। কিন্তু কেনো? কিছু বোঝার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায় বলেই কি আমাদের এই আচরণ। শুনতে
খারাপ লাগলেও একটা কটু কথা বলি, বাঙালি নাকি ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না’! যদি
মুক্তিযুদ্ধ অন্তত নয় মাস না হয়ে নয় বছর হতো; প্রতি ঘরে ঘরে
একজন শহীদ বা বীরাঙ্গনা থাকতো তাহলে হয়তো বাঙালি স্বাধীনতার মর্যাদা বুঝত এবং
ভারতের অবদানকে মেনে নিত। তাই বাংলাদেশ স্বাধীনের সুবর্ণ জয়ন্তীতে পা ফেলার আগে
আবারো বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সেই অবদানকে স্মরণ করতে চাই। পারস্পরিক দ্বিপাক্ষিক
বিষয়গুলো সমাধানের মাধ্যমে এগিয়ে যাবে এই দুই বন্ধু রাষ্ট্র এই আমাদের প্রত্যাশা।
সহজলভ্য স্বাধীনতার কারণেই কি বিজয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের
মাথায় জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম
আমরা!