১৯৯৯ সালে
বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বড় ২০টি দেশ
একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ে। জি–২০ জোটের
বর্তমান সদস্য আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স,
জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া,
সৌদি আরব, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮০ শতাংশই
এই জোটের দখলে। আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশের সঙ্গে জড়িত জি–২০ দেশগুলো। এবারের জি-২০ সম্মেলন হতে যাচ্ছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। জোটভুক্ত সবগুলো
দেশের প্রেসিডেন্ট এবার আসবেন এই সম্মেলনে। শুধুমাত্র আসছেন না পরাশক্তি রাশিয়ার
প্রেসিডেন্ট পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শী জিনপিং। এবারের প্রতিপাদ্য
“পুরো বিশ্ব একটি পরিবার”।
বাংলাদেশ জি-২০ জোটের সদস্য
না। অন্য আরো ৯ টি অতিথি দেশের সাথে
বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে মোদী সরকার। ৯ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রতিনিধি দল নিয়ে দিল্লী যাচ্ছেন জি-২০ সম্মেলনে অংশ নিতে। নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ
জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভারত ও বাংলাদেশে আগামী বছর জাতীয়
নির্বাচন, তার আগে এটাই দুই সরকার প্রধানের শেষ মুখোমুখি সাক্ষাৎ। এই কারণেই জি-২০
সম্মেলনের চেয়ে, এই সাক্ষাৎ বাংলাদেশের ভারত উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক
পরিস্থিতিতে ইন্দো প্যাসিফিক বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে যে কজন নেতৃত্ব প্রশংসিত হচ্ছেন তার মধ্যে শেখ হাসিনা
অন্যতম। বাংলাদেশের প্রতি চীনের সহযোগিতার
হাত, একইসাথে ভারতের সহযোগিতার আশ্বাস, ব্রিকসে আমন্ত্রণ জানানো, জি২০ সম্মেলনে
আমন্ত্রণ জানানোতে বোঝায় যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায়
একজন বলিষ্ঠ ও প্রভাবশালী নেতা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছেন আন্তর্জাতিক মাধ্যমে।
বাংলাদেশকে অতিথি হিসেবে ভারতের আমন্ত্রণে
দেশটি তার নিকটতম প্রতিবেশীকে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হিসেবে উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সর্বজনস্বীকৃত।
অশান্তিপূর্ণ উত্তর-পূর্ব ভারতে শান্তি এনে দিয়েছে বাংলাদেশ।
এর ফলে নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারতের কাছে অপরিহার্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।
২০২১-২২ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের
বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মহামারি সত্ত্বেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য
২০১৯ সালের ৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২১ সালে ১৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। দুই
দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে বাংলাদেশ
ভবিষ্যতে ভারতের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে
রিজিওনাল কানেক্টিভিটি বাড়াতে বাংলাদেশ মোংলা ও চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে শুরু করে দুই দেশের বাণিজ্যের জন্য বেশ কিছু নতুন পোর্ট অব কল এবং প্রোটোকল
রুটে যুক্ত করা হয়েছে। সড়ক, রেল, সমুদ্র সব রুটেই ভারতের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বৃদ্ধিতে ট্রানজিট
দিয়েছে বাংলাদেশ।
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সমন্বয়ক হর্ষবর্ধন শ্রিংলার
মতে, জি-২০ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নীতিকে
প্রভাবিত করার একটি বিশেষ সুযোগ দেবে। নরেন্দ্র মোদীর সাথে সাক্ষাতে আলোচনায় আসবে
তিস্তা ইস্যু। ৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রসচিব
মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের তিস্তার পানি বণ্টনের ইস্যু আছে, যা অবশ্যই
প্রধানমন্ত্রী উত্থাপন করবেন। আমাদের আরো কিছু সমস্যা আছে। বাংলাদেশ
ভারতের জন্য ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। আবার বাংলাদেশ ভুটান নেপালে পণ্য পরিবহনের
জন্য ভারতের কাছে ট্রানজিট চাইছে, সেটা এই দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আসার সম্ভাবনা আছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ সবচেয় বড়
সমস্যাগুলোর একটি। এই সমস্যা উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার
সম্ভাবনা আছে এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে। ভারতীয়
মুদ্রায় জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ, খাদ্য পণ্যের আমদানিতে কোটা নির্ধারণ, ভারতীয়
লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অর্থায়নের প্রকল্পে শর্ত জটিলতা নিরসন প্রসঙ্গে আলোচনা হতে
পারে।
ভারত ছাড়াও আর্জেন্টিনা, কানাডা, কোরিয়া, সংযুক্ত
আবর আমিরাত, সৌদি আরবের সরকার প্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাইডলাইনে
আলোচনা হতে পারে। এসব দেশের সাথে আলোচনায় বিনিয়োগ, রপ্তানি, জনশক্তি রপ্তানি, খাদ্য,
জ্বালানি, সার, পর্যটন ও সংস্কৃতি, নারী নেতৃত্ব উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের
মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।
সৌদি প্রতিষ্ঠান এসিডব্লিউএ পাওয়ার কোম্পানি
৩০০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এই বিদ্যুৎ
কেন্দ্রে ৪৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। গত ৬-৭ বছরে সৌদি আবরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান
৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু নানান জটিলতায় সৌদি বিনিয়োগ
নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে জি-২০ সম্মেলনে সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক
আলোচনায় বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। সৌদি
আরবে জনশক্তি রপ্তানি, জ্বালানি তেল কেনা, হজ ব্যবস্থাপনা সহজ করার বিষয়ে আলোচনা হতে
পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মধ্যপাচ্যের দেশ সৌদি আরবে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ কর্মী কাজ
করছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে বলে জানা
গেছে। জনশক্তি রপ্তানি ইস্যুতে সৌদি আরব ছাড়াও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হতে পারে সংযুক্ত
আরব আমিরাত এবং কোরিয়ার সঙ্গে।
বাংলাদেশে কানাডিয়ান বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দেশটিতে কান্ট্রি ডেস্ক চালু করেছে। বাংলাদেশের
শুল্কমুক্ত বিনিয়োগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে কানাডার বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা
হতে পারে।
এছাড়াও বৈশ্বিক রাজনীতিতে
বাংলাদশের করণীয় কি হতে পারে সে বিষয়েও কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এই
সম্মেলন। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ,
ব্রিটেনে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনের বিষয়ে নানা কথা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতকে এই পরিস্থিতি নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনায় সম্পৃক্ত করতে
চাইবে এটাই স্বাভাবিক।
লেখক-