‘এক পৃথিবী, এক
পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে আগামী ৯ ও ১০
সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০ দেশের অর্থনৈতিক জোট জি-২০ এর বার্ষিক
সম্মেলন। শিল্পোন্নত দেশগুলোর এই জোটে বাংলাদেশ না থাকলেও এবারের সম্মেলনে পাচ্ছে ‘গেস্ট কান্ট্রি’র মর্যাদা। সদস্য
দেশগুলোর বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নয়টি দেশকে ‘গেস্ট কান্ট্রি’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত
করা হয়েছে এবারের সম্মেলনে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ‘গেস্ট কান্ট্রি’র মর্যাদা পেয়েছে
বাংলাদেশ। এই সংবাদটি বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের ও গর্বের। কারণ
এমন ২০টি দেশ এই অর্থনৈতিক জোটের নেতৃত্বে আছে যারা উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপট তো বটেই
বরং বিশ্ব অর্থনীতির বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কিছু দেশ তো নেতৃত্ব পর্যায়েই রয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির ২০টি দেশের জোট জি-২০ অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী
আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা সংস্থা। যারা বৈশ্বিক জিডিপির ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি
বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশও নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বাস
করে এ জোটভুক্ত দেশগুলিতে। তাই জি-২০ সম্মেলনে ভারতের সভাপতির দায়িত্বে আসা এই উপমহাদেশের
জন্য অনেক আশীর্বাদের। ভারত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে এই সম্মেলনকে আর তাইতো ২০২৩ সালের
জি-২০ সম্মেলনের স্লোগান, লোগো, ওয়েবসাইট উদ্বোধনকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদী এ সম্মেলনকে ভারতের বুকে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক
সম্মেলন বলে অভিহিত করেন। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও এই সম্মেলন এক ভিন্ন
মাত্রা যোগ করছে।
বাংলাদেশ অতিথি দেশের সম্মান নিয়ে আগামী
সেপ্টেম্বরে দিল্লীর জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেয়াটাও অনেক তাৎপর্যের। বাংলাদেশের সামনে
নতুন এক সম্ভাবনা ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে এই সম্মেলনে। বাংলাদেশের যে ইস্যুগুলো
এখন অনেক বেশি চর্চিত, যা মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো নিয়ে উন্মুক্ত
আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক বিস্তর জায়গা তৈরি হলো। তৈরি হলো বললে কিছুটা অকৃতজ্ঞতার
শামিল হয় বরং ভারত সেই সুযোগটা বাংলাদেশকে তৈরি করে দিয়েছে বললে যথার্থ হয়। ‘গেস্ট কান্ট্রি’ হিসাবে বাংলাদেশকে
অন্তর্ভুক্ত করার ফলে ঢাকা থেকে কর্মকর্তারা দিল্লি গিয়ে এবং দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের
কর্মকর্তারা আমন্ত্রণ পেয়ে জি-২০ ফোরামের বিভিন্ন বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন। বর্তমানে কর্মকর্তাদের
বৈঠক হচ্ছে। ভবিষ্যতে মন্ত্রী পর্যায়েও বৈঠক হবে। এসব বৈঠকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ
হিসাবে বিভিন্ন সুপারিশ পেশ করবে। বছরজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি থাকবে।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের
অধিবেশন বসে, এবছর জাতিসংঘ অধিবেশনের আগে বা পরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে যা বাংলাদেশের
অগ্রাধিকার ইস্যুগুলোকে নতুনভাবে বারাংবার উপস্থাপনের সুযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের
তরফে জাতিসংঘে যে ধরনের বক্তব্য রাখা হয়; অনেকটা একই ধরনের বক্তব্য জি-২০ সম্মেলনে
রাখা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি প্রতিরোধে সাড়া, অবকাঠামো
উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সংকট প্রভৃতি বাংলাদেশের সামনে থাকা অগ্রাধিকার ইস্যুসমূহ তুলে ধরা
হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ঝুঁকির তালিকায় যেহেতু বাংলাদেশ রয়েছে তাই
সকল ফোরামে এই ইস্যুতে বাংলাদেশ সোচ্চার থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন
ইস্যুতে নিজের শক্ত অবস্থানের কারণে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী
দেশগুলোকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে তেমনি এ থেকে বাঁচতে আমাদের করণীয়সমূহ নিয়েও
কথা হচ্ছে। আবার রোহিঙ্গা ইস্যু একক সমাধানের বিষয় না, এটা এখন আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচিত
বিষয় এবং দ্বিপাক্ষিক সমাধানের বিষয় যেখানে অন্যান্য রাষ্ট্রের শক্ত ভূমিকা রাখার জায়গা
আছে। ভারত ইতোমধ্যে এই বিষয় নিয়ে নানা ফোরামে কথা বলেছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে
কাজ করার তাগিদ দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ
সমাধানের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে জাতিসংঘের পাশাপাশি জি-২০ সম্মেলনে
এই বিষয়গুলো যখন বার বার উঠে আসবে তখন আলাদা গুরুত্ব দিয়ে সর্বত্র বিবেচিত হবে। তাছাড়া
জি-২০ সম্মেলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এই সময়ের মাঝে ২০০টি থেকে ২৫০টি বৈঠক অনুষ্ঠিত
হবে। ওই সব বৈঠকেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। এবং এসব বৈঠকেও বাংলাদেশের
পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু বা জলবায়ু ইস্যুকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হবে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন
শ্রিংলা জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সমন্বয়কারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশে
ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। শ্রিংলাকে বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে বিবেচনা
করা হয়। তিনি ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার এবং পরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালে দ্বিপক্ষীয়
সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শ্রিংলা রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতকে
বাংলাদেশের পক্ষে আনার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। এবার জি-২০ সামিটে বাংলাদেশকে ‘গেস্ট কান্ট্রি’ করায় শ্রিংলার
ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্যে সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে যেতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়। এতে করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনারও সুযোগ সৃষ্টি হবে। জি-২০ সম্মেলনের সমন্বয়কারী হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, জি-২০ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ার এক অনন্য সুযোগ। নিঃসন্দেহে এই সুযোগটি আওয়ামী লীগ সরকার কাজে লাগাতে চাইবে। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ সরকার ও দেশকে আরেকবার বিশ্ব দরবারে পরিচয় করার সুযোগটি হয়তো হাতছাড়া করতে চাইবেন না। সবশেষে বলবো, বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এমন আরেকটি সুযোগ করে দেয়ার জন্য ভারত একটা ধন্যবাদ পেতেই পারে!
লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।