সময়টা
ছিলো ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখের রাত, প্রচন্ড শীতের রাত, খেয়েদেয়ে কেউ
টিভি দেখছিলেন আবার কেউবা শুয়ে পরেছিলেন। আচমকাই ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি চারদিকে
এবং 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ', 'ভারতীয় কুকুররা ফিরে যাও' স্লোগানে কেঁপে উঠে কাশ্মীরি
পন্ডিত অধ্যুষিত অঞ্চল। মসজিদ থেকে হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে দলে দলে মানুষ
গলি-মহল্লা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। অনেককেই সে রাতে হত্যা করা হয়। যে যেদিকে পারে
ছুটে চলে যেতে থাকে। আগুনে বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দেয়া হয়। সেই রাতের নির্মমতাই শেষ নয়
বরং এরপর থেকে কাশ্মীরি পন্ডিতদের পরিবারকে বেছে বেছে চিহ্নিত করে চালানো হয়
নির্মম নির্যাতন। এভাবে কাশ্মীরকে ধীরে ধীরে ‘কাশ্মীরি পন্ডিত’ সম্প্রদায় শূন্য
করে দেয়া হয়।‘হয় কনভার্ট হও, নইলে কাশ্মির ছেড়ে পালাও অথবা মরো’ এই দমন
নীতিকে সামনে এনে কাশ্মীরে হাজার বছর ধরে বাস করে আসা পন্ডিতদের আক্রমণ চালানো হয়।
ভাবার কোন কারণ নেই যে, এই ১৯ জানুয়ারির আক্রমণই প্রথম আক্রমণ ছিলো। এর আগে আরো
ছয়বার কাশ্মীর পন্ডিতদের উপর আক্রমণ করা হয়েছিলো। তবে এবারের আক্রমণ ছিলো অনেক
পরিকল্পিত। পন্ডিতদের লিস্ট করা হলো, তাদের ঘরের সামনে লিখে আসা হলো ‘ধর্মান্তরিত
না হলে মৃত্যুর জন্য তৈরী হও’। সেই রাতে হাজার হাজার কাশ্মীরি পন্ডিত প্রায় এক
বস্ত্রে কাশ্মীর উপত্যকায় নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সবাই
কাশ্মীর ছেড়ে অন্যপ্রদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। নিজের জন্মভূমি, জন্মস্থানকে
রেখে এক কাপরে পালিয়ে চলে আসতে হয় ভিন্ন স্থানে। আজ অবধি কাশ্মীরে ফিরে যেতে পারেনি কাশ্মীরি পন্ডিত সম্প্রদায়। এখনো তারা
তাদের জন্মস্থানে ফিরে যেতে সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে যাচ্ছে, রাস্তায়
আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
এই
সত্য ঘটনা প্রথমবারের মতো বিশদ আকারে পর্দায় উপস্থাপিত হলো ‘দ্য কাশ্মির
ফাইলস’ এর মধ্য দিয়ে। এই চলচ্চিত্রকে দেখতে গিয়ে পুরোটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে
ছিলাম। কখন কাঁদতে শুরু করেছি নিজেও জানি না, অনেক জায়গা এতো কষ্টদায়ক যে
দুর্বল চিত্তের কেউ দেখলে সমস্যা হতে পারে! একটা চলচ্চিত্র কিভাবে ইতিহাস আর সময়কে তুলে ধরে
তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’। আমি কোনো চলচ্চিত্র
বোদ্ধা নই তবে ইতিহাস দেখতে গিয়ে যা দেখলাম তাতে মানুষ হিসেবে নিজের উপর চরম
ঘৃণাবোধ জন্মেছে! জন্মেছে অনেক প্রশ্নও! এমন ভয়াবহ ইতিহাস এতোদিন কেনো বিশ্ব
জানেনি। কতশত চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে ভারতে কিন্তু কাশ্মীর পন্ডিতদের নিয়ে আজ
অবধি কেনো কোন নাটক, সিনেমা বা গল্প হয়নি! নিজের দেশেই উদ্বাস্তু হওয়ার উদাহরণ
অন্য কোন দেশে রয়েছে, খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। তাই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হিংসা, বুলেট, ধর্ষণের
বিরুদ্ধে লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে বানানো 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' কোনও
রাজনৈতিক সিনেমা নয়, বরং একটি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের দলিল।
'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' চলচ্চিত্রটি
দেখে সৈয়দ আলী শাহ গিলানির কথা বার বার মনে পরেছে। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী
গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন সৈয়দ আলী শাহ গিলানি যিনি ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর শ্রীনগরে
নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কাশ্মীর পন্ডিতদের হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলো
এই গিলানি। আমরা অনেকেই হয়তো এই গিলানির নাম শুনেছি আবার অনেকেই হয়তো শুনিনি। যারা
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির খোঁজ খবর রাখেন তাদের কাছে সৈয়দ আলী শাহ গিলানি নামটি
একদম অপরিচিত নয়। গিলানি ভারতের সবচেয়ে উত্তপ্ত অঞ্চল কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী
নেতা। দীর্ঘ প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির
মুখ হয়ে ওঠা কট্টরপন্থী এই নেতা ইসলামের নাম করেই যুগের পর যুগ নিজ দেশের বিরুদ্ধে
ধর্মীয় কার্ড খেলেছেন। ধর্মের নামে উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সহিংসতা ছিলো
তার এক ধরণের নেশা। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন জামাত-ই-ইসলাম কাশ্মীরের নেতা। পরে
তিনি তেহরিক-ই-হুরিয়ত গঠন করেন। ১৯৭২, ১৯৭৭ ও ১৯৮৭ সালে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের সোপোর আসন থেকে
বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং নির্বাচনে তার মূল অস্ত্রই ছিলো ধর্মীয়
বিভাজন। জম্মু ও কাশ্মীরের
বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলির সংগঠন অল পার্টি হুরিয়ত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান হিসেবে
দায়িত্বভার পালনও করেছেন তিনি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জঙ্গিবাদের
গুরু ছিলেন গিলানি। গিলানিকে কাশ্মীরে থাকা ‘পাকিস্তানের মুখপাত্র’ হিসেবেও অনেকে
ডাকতেন। পাকিস্তান প্রশ্নে তার ভূমিকার কারণেই এমনটা ডাকা হতো। এমনকি পাকিস্তান সরকারের
সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে তিনি আলাদা পরিচিতি লাভ করেছিলেন যার প্রমাণ ক্ষুদ
পাকিস্তানই দিয়েছে। ২০২০ সালের ২৭ জুলাই পাক সিনেটের উচ্চকক্ষে সৈয়দ আলি শাহ
গিলানিকে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ দেওয়ার প্রস্তাব
সর্বসম্মতিতে পাশ হয়। শুধু তাই নয়, ওই প্রস্তাবে গিলানির নামে ইসলামাবাদের একটি
বিশ্ববিদ্যলয়ের নামকরণ করতে বলা হয়েছে সরকারকে। সেই সঙ্গে, জাতীয় ও প্রাদেশিক স্তরে
স্কুলের পাঠ্যবইতেও গিলানীর জীবনীকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে! কাশ্মীর
পন্ডিতদের উপর যে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছিলো তার অগ্রভাগে ছিলো এই গিলানি। বলতে
গেলে তার নেতৃত্বেই অনেক জায়গাতে পন্ডিতদের হত্যা করা হয়েছিলো।
এবার যদি
সিনেমার কথা বলতে হয়, তাহলে পুষ্কর নাথ পণ্ডিতের চরিত্রে অভিনীত অনুপম খেরকে সাধুবাদ জানাতেই হয়
মর্মস্পর্শী অভিনয়ের জন্য। পল্লবী জোশী, মিঠুন চক্রবর্তী যথাযথ। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর
প্রশংসা প্রাপ্য শুধু বিষয় বেছে নেওয়ার জন্য নয়, বরং পুরাণ কথা, কাশ্মীরি
পণ্ডিত, কাশ্মীরিয়াত, জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়ার নগ্ন ভারসাম্য নীতি নিয়ে গবেষণার জন্য। সিনেমার
প্রথম ভাগ যদি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে পটভূমি তৈরি করে থাকে, তাহলে
দ্বিতীয় ভাগ অবশ্যই বর্তমান প্রজন্মের ক্ষেত্রে কেন অতীত নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান
থাকা দরকার এবং ভবিষ্যতের আয়না হিসেবে তার উপযোগিতা নিয়ে। টেকনিক্যাল দিক থেকে
দুর্বলতা চোখ এড়িয়ে গিয়েছে সিনেমার ট্রিটমেন্টের জন্য। এখানেই সিনেমাটির
দুর্বলতা বা সাফল্য হয়তো! যে কোনও শিল্পকর্মকেই যে প্রশ্ন তুলতে হবে এমন নয়, কিন্তু যদি
ভাবাতে না পারে, তাহলে সেটি এক ধরণের সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে। এই সিনেমা দর্শকের পছন্দ
হোক না হোক, ভাবাবে অবশ্যই। তাই ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিবেকই উত্তর দেবে যে
কাশ্মীরি পণ্ডিতের বিতরণ গণপ্রস্থান (mass
exodus) না গণহত্যা (genocide) ছিল! ততদিন
রাজেশ কৌল, কৃষ্ণা কাচরু, সুমন রায়না, প্রীতি থুসোরার মতো শিক্ষিত, মার্জিত কাশ্মীরি পরিবারের সন্তানেরা প্রশ্ন করে যাবেন
একচোখা ভারতীয় সমাজকে।
নিঃসন্দেহে কাশ্মীরি পন্ডিতদের দেশান্তরে যাওয়া কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সস্প্রীতির সংস্কৃতির এবং কাশ্মীরিত্বের অত্যন্ত শক্তিশালী চেতনার উপর সবচেয়ে বড় আঘাত। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সন্দেহ এবং অবিশ্বাস জন্মেছে যা ১৯৯০-এর আগে সম্প্রীতির সমাজে ছিলোনা। কাশ্মীরে আজ হিন্দু মুসলিম বিভেদ বা সন্দেহ যে পর্যায়ে গিয়েছে তার পেছনে দায়ী সেই পূর্বেকার ঘটনা। বর্তমানে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর একটা পথ তৈরি হয়েছে কাশ্মীরি পন্ডিতদের কাশ্মীরে ফিরিয়ে আনার। ইতোমধ্যে এই প্রক্রিয়া নরেন্দ্র মোদীর সরকার শুরুও করেছে। হাজারো পন্ডিত বা তাদের পরিবার হয়তো স্বপ্ন দেখছেন নিজ ভূমিতে ফেরার। সময় বলে দেবে কাশ্মীরি পন্ডিতরা নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরে আসতে পারবে কিনা তবে ১৯৯০ সালে যে ভয়াবহ এথনিক ক্লিনজিং এর শিকার তারা হয়েছিলেন তা কিন্তু আজো ভুলেন নি পন্ডিত সম্প্রদায়। আজো সেই দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায় কাশ্মীরি পন্ডিতদের!
লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ,
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।