ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা ও সামাজিক কুসংস্কারে আবদ্ধ তৎকালীন বাঙালি সমাজে নারী শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তখনকার সমাজব্যবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোন সুযোগ ছিল না। তাই প্রথম জীবনে গোপনে ভাইবোনদের সমর্থন ও সহযোগিতায় আরবী, ফারসি, উর্দু ও বাংলা আয়ত্ত করেছিলেন বেগম রোকেয়া। তবে শিক্ষালাভ ও মূল্যবোধ গঠনে বড় দুভাই ও বোন রোকেয়ার জীবনকে প্রভাবিত করলেও তাঁর আসল লেখাপড়া শুরু হয়েছিল বিয়ের পর স্বামীর সাহচর্যে। ১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পর বেগম রোকেয়ার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল। স্বামীর অনুপ্রেরণায় বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জনের সাথে সাথে সাহিত্যচর্চায়ও মনোনিবেশ করেন বেগম রোকেয়া।
১৯০২ সালে নভপ্রভা পত্রিকায় ‘পিপাসা’ প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পান তিনি। তাছাড়া ১৯০৫ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য রচনা ‘সুলতানাস ড্রিম’ যার অনূদিত রূপ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশের মাধ্যমে সর্বজন পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। নারীর এগিয়ে চলার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং নারী পুরুষের মধ্যে সমতার পক্ষে তিনি যুক্তি তুলে ধরেছেন তাঁর সকল লেখায়। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মিশ্রনে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থানের কথা সবসময়ে ফুটে উঠেছে তাঁর দৃপ্ত কলমে। লেখালেখির বাইরে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ পরিবর্তনে এবং নারীশিক্ষার বিস্তারে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন বেগম রোকেয়া। নিজের সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বর্তমানে কলকাতার নামকরা মেয়েদের সরকারি স্কুল -সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স হাই স্কুল। বিপুল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সারা জীবন তিনি পিছিয়ে থাকা নারী সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে অধিকার সচেতন করে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। এটি নারীদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করতো।
নারী জাগরণের এই পথিকৃত ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসি বাংলার 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি' জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। তার কর্ম ও আদর্শকে উদযাপনের লক্ষ্যে জন্ম ও মৃত্যুদিন ৯ ডিসেম্বরকে ‘বেগম রোকেয়া দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।