×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৪-০৪
  • ৩৩৯ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের জ্বালানি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ভারত থেকে জ্বালানি আনতে ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন এর উদ্বোধন করেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। গত ১৮ মার্চ এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারতের আসাম রাজ্যের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুর ডিপো পর্যন্ত ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ জ্বালানি তেলের পাইপলাইনের উদ্বোধন করা হয়। এই পাইপলাইনের বাংলাদেশের অংশে পড়েছে ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার, ভারতের অংশে ৫ কিলোমিটার। ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় নিরবচ্ছিন্ন, দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। উত্তরাঞ্চলের দৈনিক অতিরিক্ত ২৯ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি মজুদ সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এই পাইপলাইন। এতে জ্বালানি তেল সংকট দূর হবে দেশের উত্তরাঞ্চলে।

উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যক্ষ করতে হয় পর্যদুস্থ অর্থনীতি ও স্থবির বাণিজ্যের এক বাংলাদেশকে। মূলত ২০০৯ সালের পূর্বে বিদ্যুতের অভাবে দেশের অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য ভঙ্গুর হয়ে পরেছিলো এবং জনজীবন অতিষ্ঠ ছিলো লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতায়। আর গ্যাস সংকট তো ছিলো নিত্য সময়ের সঙ্গি। তাই ক্ষমতায় এসে প্রথমেই জ্বালানী সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়ে উঠেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যার দূরদর্শী পদক্ষেপে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হয় বাংলাদেশ। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জ্বালানী চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টি অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানী উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশসমূহ হতে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতার মাধ্যমে আমদানি কার্যক্রম গ্রহণ করে। আর এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পায় ভারতের সহযোগিতা।

গত ১৪ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার খুবই সফলতার সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে ভারতের সাথে কাজ করে আসছে। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন এক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ( বিপিসি) ২০১৭ সালের এপ্রিলে পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে ডিজেল আমদানির জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি সই করে। একই বছরের অক্টোবরে এনআরএল বাংলাদেশে গ্যাস ও তেল (ডিজেল) রপ্তানির জন্য বিপিসির সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদী আরেকটি চুক্তি সই করে। ভারতের নুমালীগড় থেকে ১৩১.৫০ কিলোমিটার পাইপলাইনে বাংলাদেশের পার্বতীপুর ডিপোতে ডিজেল আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গত ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তখনই জানানো হয়, এ ১৩১.৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ভারতের অংশে পাঁচ এবং বাংলাদেশের অংশে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১২৬.৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। ৩ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের সময়কাল ছিল ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রকল্পটি শেষ হয় এবং নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা। ভারত ১৫ বছর ডিজেল সরবরাহ করবে তন্মধ্যে প্রথম তিন বছর দুই লাখ মেট্রিক টন, পরবর্তী তিন বছর তিন লাখ মেট্রিক টন, এরপর চার বছর পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ও অবশিষ্ট পাঁচ বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন তেল সরবরাহ করবে।

ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন চালুর ফলে দুই দেশের জনগণ বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যখন বিশ্বের অনেক দেশ জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি, এই পাইপলাইনটি জনগণের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই পাইপলাইনে ভারত থেকে ডিজেল আমদানিতে ব্যয় ও সময় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করবে।

দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার কারখানাকে গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া অর্থনৈতিক গতিশীলতার স্বার্থে একান্ত অপরিহার্য বিবেচিত হয়। পক্ষান্তরে গৃহস্থালি তথা আবাসিক শ্রেণিতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া অর্থনৈতিকভাবে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে এলপিজির সহজলভ্যতা এবং ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় গৃহস্থালি পর্যায়ে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া পরিপত্রের মাধ্যমে বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃদ্ধি না পেলে এবং শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা হ্রাস না পেলে আবাসিক গ্যাস সংযোগ উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক গড়ে প্রায় ২ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে বিবেচনায় অবশিষ্ট মজুদকৃত গ্যাস দিয়ে প্রায় ১১ বছর দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। তাই এই পাইপলাইন জ্বালানি সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, ভাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবাধ প্রবাহ। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সেতুবন্ধন দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর করেছে। বিগত বছরগুলোতে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাকে দুই দেশ বাস্তবে রূপ দিয়েছি। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সমস্যাগুলো একে একে সমাধান করা হচ্ছে। যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে দুই দেশ। উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে দুই দেশ এবং ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা পাচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সেটাই আমরা চাই। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে সেটাকে কার্যকর করতে ভারতের সহায়তা ও সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি দরকার। তাই বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের মতো সর্বক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী এগিয়ে যাক সেই কামনা রইলো।

লেখক-হাসান ইবনে হামিদ,

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat