নুপূর শর্মার বক্তব্য নিয়ে
কিছুদিন আগে উত্তাল ছিল রাজনীতি। ধর্মীয় ভাবাবেগ ইস্যুতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের
মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। এর মাঝের ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক অনেক
জায়গাতে এসেছে। ধর্মকে সামনে এনে স্বাভাবিকভাবেই ঘোলা পানিতে অনেকে মাছ শিকার করতে
চেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ধর্মীয় ভাবাবেগটা তখন অনেকের নজরে এসেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাষ্ট্রই তখন ভারতের উপর ক্ষুব্ধ ছিলো বলেও আমরা জানতে পেরেছি
গণমাধ্যম মারফতে। কিন্তু এই রাগ ক্ষুব্ধতা কি ধর্মকে ভালোবেসে নাকি এর পেছনে ভিন্ন
কোন রাজনীতি ছিলো তাও আলোচনায় এসেছে। কারণ নুপূর শর্মা তো এক বক্তব্য দিয়েছে
ইন্ডিভিজুয়াল পার্সন হিসেবে, অথচ দিনের পর দিন বছরের পর বছর আমরা দেখেছি ইজরাইল কি
নির্মম নির্যাতন করছে ফিলিস্তিনের উপর অথচ সেখানে কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য নীরব। অথচ
ধর্মীয় কারণে যদি কোন পদক্ষেপ নেয়ার দরকার হতো তবে মধ্যপ্রাচ্য সবার আগে তো
ইজরাইলের বিরুদ্ধে নিতো! কিন্তু আমরা দেখেছি উল্টো তাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক
রাষ্ট্র শান্তিচুক্তি পর্যন্ত করেছে। তাহলে এখন কেন এমন অবস্থায় গেলো মধ্যপ্রাচ্য?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে, আলোচনাটা সাদামাটাভাবে
করলে হবে না।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ব
রাজনীতির মেরুকরণের কারণে বিজেপি বা ভারতকে সাময়িক সমস্যায় পরতে হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমেরিকার সাথে স্পষ্ট একটা স্বার্থকেন্দ্রিক
দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয় ভারত-আমেরিকার মধ্যে। রাশিয়ার উপর অবরোধের পর রাশিয়ার তেল
বিক্রি হাতেগুণা কিছু দেশের কাছে করেছে তার মধ্যে ভারত অন্যতম। রাশিয়ার উরাল তেলে
ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৩০ ডলার ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছে।এই সুযোগ ভারত কাজে লাগিয়েছে
বিপুল পরিমাণ তেল রাশিয়া থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে। আর এতে একইসাথে আমেরিকার স্বার্থে
আঘাত লেগেছে এবং সরাসরি বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। কারণ ভারত
সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করতো মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ২০২১ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রায়
১ কোটি ২০ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছিল ভারত যা ওই বছর ভারতের মোট আমদানি করা তেলের
মাত্র ২ শতাংশ।২০২১ সালে ভারত সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
যুক্তরাষ্ট্র ও নাইজেরিয়া থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তেল আমদানি করা হয়েছিল। ফলে
পুরো বিজনেস এবং পলিটিক্সে আমেরিকা ও তার
মিত্র মধ্যপ্রাচ্য চরমভাবে ক্ষতির সম্মুখীন ছিলো। তারা শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিলো
ভারতকে ফাঁদে ফেলার। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই নুপূর শর্মা আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের
প্রাণভোমরা হয়ে আসলেন, দিলেন এক বক্তব্য, এ যেন মেঘ না চাইতেই
বৃষ্টি!
ভারত তার বিদেশনীতির ক্ষেত্রে
সবসময়ই নিজ দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে
ভারতের অবস্থান ছিলো পরিস্কার। বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক কৌশলে ভারত নিজ দেশের মানুষের
স্বার্থ আদায়ে কাজ করেছে। মার্কিন সতর্কতা সত্ত্বেও নিজ দেশের জনগণের স্বার্থে
যুক্তরাষ্ট্রের কোন ধরণের বক্তব্যকে
পাত্তা না দিয়ে রাশিয়া থেকে কম দামে বেশি তেল কিনছে ভারত। ইউক্রেনে যুদ্ধ
শুরুর পর রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। পাশাপাশি রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস কেনার ক্ষেত্রে
বিশ্বের অন্য দেশগুলোকেও প্রতিশোধমূলক নিষেধাজ্ঞার বার্তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কিছু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে না। ফলে স্বাভাবিক সময়ের
চেয়ে কম দামে তেল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে রাশিয়া। তাই লাভের আশায় মার্কিন হুমকি
উপেক্ষা করেই দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে ভারত।
এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, রাশিয়ার তেল কেনা এড়াতে
আমেরিকার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। দেশটি জানায়, জ্বালানি
আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের নির্ভরতা ‘রাজনীতিকরণ’ করা
উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রও অগত্যা এই যুক্তি মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ, ভারত সরকার তার কূটনৈতিক বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে আমেরিকার মুখও বন্ধ করে দিয়েছে
আবার নিজ দেশের জনগণের স্বার্থে কম দামে বেশি তেলও কিনে রাখছে। এমন সাহসী ও
বিচক্ষণ পদক্ষেপের জন্য শুধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই না বরং বিশ্বের অন্যান্য
দেশ থেকেও মোদী সরকার বাহবা পাচ্ছে। অপরদিকে রাশিয়া ইউক্রেন পরিস্থিতি পাকিস্তানের
রাজনীতিকে এতোটাই প্রভাবিত করেছে যে, ইমরান সরকারের পতন
পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানী জনতার একটা বিরাট অংশ মনে
করে, ইমরান সরকারের পতনের পেছনে আমেরিকা দায়ী। নুপূর শর্মা
ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে কে কি স্টেপ নিলো তার চাইতেও বড় ব্যাপার হচ্ছে ভারত সরকার
নিজ দেশের স্বার্থকে রক্ষা করতে গিয়েই এই সমস্যায় পরতে হয়েছে।
ধর্ম কখনোই অর্থনীতির নিশ্চয়তা
দিতে পারেনা, পারেনা পেটের ক্ষুধা মেটাতে,সেটা
যে ধর্মই হোক। কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও এটা বাস্তবতা। আর তাই ধর্ম ব্যবহৃতই হয়
রাজনীতিতে মানুষকে ধোঁকা দিতে। মানুষকে নিয়ে ফুটবলের মতো খেলে পলিটিশিয়ানরা শুধু
এক ধর্ম দিয়ে। প্রকৃতপক্ষেই ধর্ম বা মুসলমানদের উপর আঘাতের বিবেচনায় যদি
মধ্যপ্রাচ্য এমন স্টেপ নিতো তবে বহু আগেই ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হতো। সংযুক্ত
আরব আমিরাত বা অন্য আরব রাষ্ট্রগুলো ইজরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি নামক নাটক মঞ্চস্থ
করতো না। ধর্ম কেবল গুটি হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে সমাজে রাষ্ট্রে। ভারত বা
বাংলাদেশ বা অন্য কোন দেশে এর ব্যবহার মূলত হয়েছেই রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে। নুপূর
শর্মার বক্তব্যের পর ভারতের বিরুদ্ধে যে বা যারা একশনে গিয়েছে কিন্তু অন্যান্য
মুসলিম নির্যাতনের ব্যাপারে যারা চুপ ছিলো সেখান থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি ধর্মের
রাজনৈতিক ব্যবহারকে।
লেখক- হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।