×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০২-২৮
  • ১৮৮৭ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

অনুন্নত বা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক সাহায্য একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সাহায্য পরিকল্পনা, অনুদান হোক বা ঋণে হোক নিঃসন্দেহে তা একটি রাষ্ট্রের কাঠামোগত উন্নয়নের ব্যাপক প্রসার ঘটায়। বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের প্রধান লক্ষ্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে বিরাজমান ফাঁক পূরণ করা এবং আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ঘাটতি দূর করা। বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজকের যে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে তার পেছনে বড় অবদান রয়েছে বৈদেশিক সাহায্যের। বাংলাদেশে এখন বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমাগত প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সাহায্যপ্রার্থী দেশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে দাতাগোষ্ঠীগুলি বাজেট করার সময় প্রায়শ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে কোন রাষ্ট্র বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে যখন অন্য আরেকটি দেশকে সহায়তার জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখে সেটা আলাদা একটা গুরুত্ব বহন করে। দাতা রাষ্ট্র নির্দিষ্ট একটি ক্যাটাগরির ভিত্তিতেই বাজেটে অন্য দেশের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখে। আঞ্চলিক অবস্থানে একটি রাষ্ট্রের গুরুত্ব এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর নির্ভর করেই দাতা রাষ্ট্র তার বাজেটে অন্যদেশের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখে। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় বাজেটে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০০ কোটি রুপি। দেশটির কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০২২-২৩ সালের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এ তথ্য জানিয়েছেনভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই টাকা আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে খরচ করা হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, গতবারের বাজেটে এই বরাদ্দ ছিল ২০০ কোটি রুপি। অর্থাৎ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ বছরে এসে আরো ১০০ কোটি রুপি বেশি বরাদ্দ রেখেছে বাংলাদেশের জন্য। নিঃসন্দেহে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নিদর্শন এটি।

ভারতের প্রতিবারের কেন্দ্রীয় বাজেটেই অন্য দেশের জন্য বেশ কিছু টাকা সাহায্যার্থে বরাদ্দ করে রাখা হয়। এবারের বাজেটও তার ব্যতিক্রম নয়। সাধারণত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কয়েকটির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং সে সব দেশকে নানাভাবে সাহায্যের জন্য বাজাটে এই অর্থটি বরাদ্দ করা হয়। তবে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ছাড়াও আফ্রিকার বহু গরিব দেশ এবং এশিয়ার কিছু দেশকেও সাহায্য করা হয় ভারতের তরফে। গতবারের বাজেটে যেসব দেশের জন্য যা অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল, তাদের অনেকগুলির ক্ষেত্রেই এবার বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ কমানো হয়েছে। এই তালিকায় একেবারে প্রথম দিকেই ভুটানের নাম। গত বছর ৩০০৪.৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল এই দেশটির জন্য। এবার তা কমিয়ে করা হয়েছে ২২৬৬.২৪ কোটি। আফগানিস্তান ৩৫০ কোটি থেকে ২০০ কোটি, নেপাল ৯৯২ কোটি থেকে ৭৫০ কোটি। এমনই ঘটনা ঘটেছে আরও বহু দেশের সঙ্গেও। যদিও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মাঝে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। গতবারের তুলনায় এবার বাংলাদেশের খাতে বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে, ২০০ কোটি থেকে ৩০০ কোটিতে গিয়েছে এ বরাদ্দের পরিমাণ।

উন্নয়ন কর্মকান্ডে অর্থ যোগানোর একটি প্রধান উপায় বৈদেশিক সাহায্য। বাজেটে অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমেও অনেক রাষ্ট্র এই সাহায্য বা সহায়তা করে থাকে। যেমনটা ভারত আমাদেরকে ৩০০ কোটি রুপি বরাদ্দের মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যকে সাধারণত চারটি প্রধান ধরণে ভাগ করা হয়। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ যা সাধারণত দশ বা বিশ বছর ধরে গ্রহীতা দেশ কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ্য। দ্বিতীয়ত, নমনীয় ঋণ যা স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ্য, যার পরিশোধের মেয়াদ দীর্ঘ, অথবা যা অত্যন্ত কম সুদে পরিশোধযোগ্য। সবচেয়ে সুবিধাজনক বৈদেশিক সাহায্য হচ্ছে সরাসরি অনুদান। স্থানীয় মুদ্রায় প্রদেয় অর্থের বিনিময়ে কোন একটি দেশের উদ্বৃত্ত পণ্যের সরবরাহ, যথা পিএল ৪৮০-এর অধীনে আমেরিকার খাদ্যসাহায্য হলো তৃতীয় ধরন; এবং সবশেষে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কারিগরি সাহায্য দান হলো চতুর্থ ধরনের বৈদেশিক সাহায্য। বৈদেশিক সাহায্য মূলত সরকারি ভিত্তিতে যোগান দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত মানরীতি অনুযায়ী বৈদেশিক সাহায্য বলতে কেবল রেয়াতি শর্তাবলিতে প্রাপ্ত ঋণ ও দান বোঝায়। এগুলি থেকে বাদ যায় সামরিক সহায়তার রূপে মজুত তহবিল স্থানান্তর, বিদেশি বেসরকারি সংস্থাগুলি প্রদত্ত সাহায্য, অর্থ যোগানদারের অগ্রিম ঋণ, রপ্তানি ঋণ, বৈদেশিক লগ্নি বিনিয়োগ, বৈদেশিক সরকারি বিনিয়োগ এবং শতকরা ৫% বা তদূর্ধ্ব সুদের হারে কঠিন শর্তাধীনে ঋণ অথবা বারো বছরের কম সময়ের মধ্যে পরিশোধ্য ঋণ। বাংলাদেশে বিদেশি ঋণদাতাদের মধ্যে রয়েছে বিশেষ বিশেষ দেশ, বহুজাতিক অর্থ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক এজেন্সি ও প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের শ্রেণিকরণ হয় সাহায্যের শর্ত, উৎস ও ব্যবহার ইত্যাদির ভিত্তিতে। নানা ধরনের বৈদেশিক সাহায্য হলো ঋণ ও অনুদান, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সাহায্য, অথবা খাদ্যসাহায্য, পণ্যসাহায্য, প্রকল্প সাহায্য এবং কারিগরি সাহায্য।

বাংলাদেশের জন্য ভারতের বাজেটে বরাদ্দ নতুন কিছু নয়।  বিগত এক দশকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০১০ সালের এলওসি চুক্তির মাধ্যমে এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ভারত বাংলাদেশের অংশীদার হয়। এখন পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের মধ্যকার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের তিনটি লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই এলওসির মাধ্যমে যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারত ধীরে ধীরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম এলওসি স্বাক্ষরিত হয় ২০১০ সালে। সে সময় বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সুবিধা বাড়ায় দেশটি। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েনের সময় ভারত সরকার ওই ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে ১৪ কোটি ডলার পদ্মা সেতুতে অনুদান দেয়। বাকি ৮৬ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি সই হয় পণ্য কেনাকাটা, রেলওয়ে অবকাঠামো নির্মাণ, নদী খনন, সেতু নির্মাণ, বাস, রেলের ইঞ্জিন ও বগি কেনাকাটা এবং সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা সংস্কারের জন্য। চুক্তির ১৫ প্রকল্পের মধ্যে ১২টি শেষ হয়েছে। ৮৬ কোটি ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি ডলার। ২৬ কোটি ডলার এখনো খরচ হয়নি।

এরপর ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের এলওসি চুক্তি করে। সে বছরের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে সফরকালে এই এলওসি চুক্তি ঘোষণা করেন। এই ঋণ চুক্তির অধীনে ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব প্রকল্পে রেল, বিদ্যুৎ, সড়ক ও পরিবহণ, স্বাস্থ্য ও কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩ প্রকল্পে পরামর্শক/কেনাকাটার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এই চুক্তির আওতায় দেড় কোটি ডলার খরচ হয়েছে। এসব প্রকল্পের অনেকগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। আবার কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ধীন।

ভারত-বাংলাদেশ এর মাঝে ২০১৭ সালে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের তৃতীয় এলওসি চুক্তি হয়। এই এলওসি চুক্তির অধীনে আরও ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই এলওসির অধীনে যে প্রকল্পগুলো পড়েছে তা হলোঃ পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ অন্যত্র নেওয়ার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, পায়রা বন্দর টার্মিনাল নির্মাণ, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার, সৈয়দপুর বিমানবন্দর আধুনিকায়ন, বেনাপোল থেকে যশোর হয়ে নড়াইল-ভাঙ্গা পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, মোংলা বন্দর উন্নয়ন, মিরসরাইতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ঢাকার রাস্তায় এক লাখ এলইডি বাতি সংস্থাপন, মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করা এবং বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে ৫টি প্রকল্প আছে টেন্ডারিং পর্যায়ে, বাকি ১১টি প্রকল্প আছে ডিপিপি পর্যায়ে। এ পর্যন্ত এসেছে ১২ লাখ ডলার। এ বছরের এপ্রিলে প্রতিরক্ষা খাতে কেনাকাটার জন্য ৫০ কোটি ডলারের শেষ ঋণচুক্তিটি সই হয়। তবে এর আওতায় কী কী কেনাকাটা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আর তাই এই প্রকল্পটিও একটু দেরি হচ্ছে।

বাংলাদেশে দাতাদের সাহায্য-সহযোগিতা নির্ভর করে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ এবং বৈদেশিক সাহায্যের দক্ষ ব্যবহার করার শর্তের ওপর। এক্ষেত্রে দাতা দেশগুলির সঙ্গে সমন্বিত সম্পর্ক আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার সচল ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখছে। বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায় বিচিত্র উপায়ে, যেমন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঘন ঘন সংলাপমূলক সভার অনুষ্ঠান করে এবং নিয়মিত আন্তঃমন্ত্রণালয় আলাপ-আলোচনা করে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাজ করে যাচ্ছেন ভারত সরকারের সাথে। আমরা দেখি নিয়মিত ভারত-বাংলাদেশ এর ওপেন ডায়ালগ, সমন্বিত আলোচনা এমনকি নানামুখী কার্যক্রম যা দুই দেশের সম্পর্ককে মজবুত করছে এবং এর প্রভাব পড়ছে বাজেটেও। আর তাই করোনা মহামারির মাঝেও আমরা দেখি, ভারত সরকারের বাজেটে বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক বরাদ্দ আগের বছরের চেয়ে ১০০ কোটি বাড়ানো হয়েছে। এই বাজেট বরাদ্দ দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো জোড়ালো করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। 

লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ,

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat