×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০১-২৯
  • ৭৪১ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

২০০৯ সালের পর থেকে একের পর এক দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের সমাধান করেছে হাসিনা-মোদী সরকার। এই সমাধান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের দেশছাড়া করাট্রানজিট দেয়াআন্তর্জাতিক মঞ্চে দিল্লির পাশে থাকা, অপরদিকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দিল্লী ঢাকার বাইরে না যাওয়া, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য পরিকাঠামো খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়া এবং সবশেষে  মহাকাশ প্রযুক্তিতে ভারতের সাহায্য করার ইচ্ছে প্রকাশ করা এক ভিন্ন বার্তাই দেয়। ২০২১ সালের ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের আলোচনায় ফের সীমান্ত হত্যা উঠে এসেছে। ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। দুই দেশ সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় আনার ব্যাপারে ঐক্যমতে বহু আগেই এসেছে এবং আবারো এ ব্যাপারে তাদের আলোচনা এবং কার্যকারিতা চালিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছে।

দুদেশের সম্পর্কের মাঝে বিষফোঁড়া হলো সীমান্ত হত্যা, সীমান্ত হত্যা নিয়ে দুদেশের সম্পর্ক প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সীমান্ত হত্যা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই আছে। যেমন, আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তকে বলা হয় মৃত্যুফাঁদ কারণ পৃথিবীর সবচাইতে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে এই সীমান্তে। অতীতে যেখানে সীমান্ত হত্যা ছিলো প্রতি বছরে প্রায় ১০০ এর উপরে বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৩০ এর নীচে। যাই হউক, কোন হত্যাকান্ডই কাম্য নয় এবং এই সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুদেশকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার আহবান আমরা সকলেই জানাই। উল্লেখ্য যে পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে এই সীমান্ত হত্যা অনেক কম তবে শূন্যের কোটায় এই সীমান্ত হত্যা নিয়ে আসতে হবে। এ নিয়ে আলাদাভাবে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী কাজ করছে। ২০২১ সালের নরেন্দ্র মোদীর সফরেও এ নিয়ে পৃথক আলোচনা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর চূড়ান্ত করতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকা অবস্থানকালীন সময়েই সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা হয়। সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সীমান্তে অপরাধ কমানোর বিষয়ে জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন তাদের লক্ষ্য হলো- ''অপরাধ নয়, মৃত্যুও নয়''- সীমান্তের ক্ষেত্রে এ নীতির ওপর জোর দেয়া। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন,

"বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। প্রত্যেকটি মৃত্যুই দু:খজনক। কিন্তু কেন হচ্ছে বা সেখানে সমস্যা আসলে কী? সমস্যার কারণ হলো অপরাধ। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত -নো ক্রাইম, নো ডেথ। আমি নিশ্চিত আমরা যৌথভাবে এতে দৃষ্টি দিতে পারবো।"  

(৪ মার্চ, ২০২১, বিবিসি বাংলা)।

পরবর্তীতে নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরেও সীমান্ত হত্যা আলোচনার মূল প্রায়োরিটি লিস্টে ছিলো। নরেন্দ্র মোদীর সাথে বৈঠকে এই বিষয়টিও জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  সীমান্তে একজন বাংলাদেশিও যেন কোনো কারণে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত না হন, সেটি নিশ্চিত করার জোরালো দাবি বৈঠকে তুলেন তিনি। সীমান্তে শান্তি, সম্প্রীতি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার লক্ষ্যে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশও দেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।

সীমান্ত হত্যার বিষয় নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা হয় এবং হচ্ছে। আর এই আলোচনা এবং দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমেই আজ আগেরচাইতে সীমান্ত হত্যা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া এখানে একদিনে নির্মূল সম্ভব নয়। তাছাড়া আমরা একতরফা একটা চিন্তা সবসময়ই করে থাকি কিন্তু এর বাইরেও নানাবিধ চিন্তা আছে যেটা কিছুটা অস্বস্তি হলেও আজকের লেখায় তুলে ধরবো।

সীমান্তে প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং বিয়োগান্ত হলেও সীমান্তে নিরস্ত্র লোকজনের অবৈধ পারাপারের সঙ্গে একে মিলিয়ে বিভ্রান্ত হওয়াটা উচিত হবে না। কারণ, সাধারণ মানুষ যখন দুর্ঘটনাবশত কিংবা পরিকল্পিতভাবে অনুপ্রবেশের সময় ধরা পড়ে যান, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা আটক লোকজনের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা নিয়মিতভাবেই করেন। অনুপ্রবেশের সময় আটক হওয়া লোকজনের পর্যাপ্ত বৃত্তান্ত না থাকলে তাদের ফেরত পাঠানো হয় না। এসব লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য তাদের স্থানীয় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪৬০ জন বাংলাদেশিকে বিজিবির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আর সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের কারণে হস্তান্তর করা হয়েছে ১২৪ বাংলাদেশিকে।

সীমান্তে অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে সহিংসতার যে ঘটনাগুলো ঘটে, এবার সেগুলোকে যাচাই করা যাক। সীমান্তে ভারতের অংশে মোতায়েনকৃত বিপুলসংখ্যক সীমান্তরক্ষী নিয়মিত টহল দেন। সাধারণত রাতে চারজনের একটি দল টহলে থাকেন। আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে সীমান্তে সহিংসতা কমানো এবং সুরক্ষার স্বার্থে একজনের কাছে জীবনঘাতী অস্ত্র থাকে। অন্যদের কাছে থাকে প্যালেট গান (জীবনঘাতী নয় এমন অস্ত্র)। সীমান্তে কোনো রকম চাপ সৃষ্টি হলে তারা সমন্বয় করে থাকে। এখন চোরাকারবারীর সময় ভারতীয় অংশ থেকে একটি দল এসে সীমান্তে জড়ো হয়। বাংলাদেশ অংশ থেকে একটি দল এসে জড়ো হয়। চোরাকারবারিরা কাঁটাতারের বেড়া কেটে গরু পার করার চেষ্টা করে। সীমান্তের দুই পাশে লম্বা কাঁটাতারের বেড়া থাকায় তারা দ্রুত তা কাটতে পারে না। এ জন্য কখনো কখনো তারা কাঁটাতারের ওপর দিয়ে গরু পার করে দিতে ক্যান্টিলিভারসহ ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে আসে। এখন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী যখন আমাদের অংশে চোরাচালানকারীদের বাধা দেয়, তারা সহিংসতা শুরু করে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তুলনায় সংখ্যা বেশি থাকা এসব লোকজনের হাতে দা, ধারালো অস্ত্র ও লাঠি থাকে। এ কারণে সীমান্তরক্ষীদের জন্য জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়। সাধারণত চোরাচালানকারীরা আগে থেকেই জানে কোন সীমান্তরক্ষীর হাতে জীবনঘাতী অস্ত্র রয়েছে। তাই শুরুতেই অস্ত্র বহনকারী সীমান্তরক্ষীর ওপর তারা হামলা চালায়। সীমান্তের দুই পাশ থেকে আসা লোকজনই এটা করে। গভীর রাতের অন্ধকারে এটি ঘটে বলে আপনি বুঝতে পারবেন না এদের মধ্যে ভারতীয় কে আর বাংলাদেশি কে। তা ছাড়া দেখতে তো এদের সবাই একই রকম। সীমান্তে সহিংসতার সব ঘটনায় বিএসএফের সদস্যরা ধারালো অস্ত্রের হাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন, কারও হাত কাটা পড়েছে, কেউ কবজি হারিয়েছেন। বিষয়টি এমন নয় যে সীমান্তরক্ষীরাই শুরুতে লোকজনের ওপর গুলি চালাতে চেয়েছেন। এ যুক্তির পক্ষে কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া যেতে পারে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে ভারতীয় ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে ১২৪ বাংলাদেশি প্রাণ দিয়েছেন। একই সময়ে এসব ঘটনায় নিহত ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ৯০। এ সময়ে সহিংস এসব ঘটনায় ১৭ জন বিএসএফ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ১ হাজার ৩৯ জন বিএসএফ সদস্য আহত হয়েছেন। এবার ভাবুন অবস্থাটা কি? কাজেই সীমান্তে আমাদের অংশে বিয়োগান্ত সহিংসতার শিকার হওয়া লোকজন অবৈধ অভিবাসী নন। কাজের জন্য অবৈধ পারাপার দুই পার থেকে ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রটোকলটা অনেক মানবিক। সীমান্ত পারাপারের সময় লোকজনের প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটে না। তবে সহিংসতা এবং মৃত্যু একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বলা চলে বিষয়টি আলাদা; যা অবৈধ অভিবাসন নয়। লোকজন ভারতে কিংবা বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার জন্য এটা করে না। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যেই তারা এটা করছে। তবে হ্যাঁ এটাও সত্যি যে এইটাকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে মৃত্যু কাম্য নয় বরং ভিন্ন উপায় বের করতে হবে এই সীমান্ত হত্যা রোধ করতে। আর তার জন্য যেভাবে দুই দেশ নিয়মিত মিটিং সভা করছে তাতে এটা স্পষ্ট যে দুই দেশ আন্তরিক এই হত্যা রোধ করতে। আন্তরিক বলেই সীমান্ত হত্যা বছরের পর বছর অনেক কমে আসছে। আমরা আশাবাদী, পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রেখে এই সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনবে দুই দেশ।

কানেকটিভিটির প্রশ্নেও অগ্রসর হয়েছে দুই দেশ। ২০২১ সালে এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বেশ অগ্রগতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বাংলাদেশ সফরকালে এ নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলেছেন। তিনি বলেন,

"সামনে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারে কানেকটিভিটি। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সঠিক কানেকটিভিটি হলে পুরো অঞ্চলের ভূ-অর্থনীতির পরিবর্তন হবে। বঙ্গোপসাগরকেই ভিন্ন দেখাবে এবং আমরা বিশ্বাস করি এটা সম্ভব। আমরা মনে করি তৃতীয় দেশকে অন্তর্ভুক্ত করেও এটা করা যায়। বে অফ বেঙ্গলে কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে আমরা জাপানকে নিয়ে কাজ করতে পারি, কারণ জাপানের সাথে আমাদের উভয় দেশের চমৎকার সম্পর্ক আছে।"

মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকালেও এই ইস্যুতে দুই দেশ কথা বলেছে। সংযুক্তির অংশ হিসেবে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে আরও বড় পরিসরে যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা চালু করতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য নতুন কিছু রুট (পথ) অনুমোদনের জন্য ভারতকে বাংলাদেশ অনুরোধ করেছে। ভারতমিয়ানমারথাইল্যান্ডকে নিয়ে প্রস্তাবিত যে ত্রিদেশীয় মহাসড়ক হচ্ছে, বাংলাদেশ যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে। আবার সংযুক্তির অংশ হিসেবে ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু চালু হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। (চলবে...) 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat