×
  • প্রকাশিত : ২০২১-১০-১৬
  • ১০৭৯ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক
-আমার শৈশব কেটেছে বরিশালে, বাসা হলো হাসপাতাল রোডে, সেখানে যেকোনো পূজায় আমাদের আনন্দ এক ফোঁটাও কম ছিল না।
আমাদের সময়ে ‘সর্বজনীন দুর্গোৎসব’ মনে হয় বাংলা রচনার বর্ণনা অনুযায়ী আসত। কীর্তনখোলার ওপারে কাশফুলের মাথা দোলানো আর সুনীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সকালের শিশির সিক্ত শিউলিফুল আর সোনালী রোদের ম্যাজিক।
দুর্গাপুজো আসার মানে ছিলো ঢাকের ছন্দে ছন্দে নতুন গল্পের বই পাওয়ার দিন। আনন্দমেলা, দেবসাহিত্য কুটীরের কাঠমলাটের পূজাবার্ষিকী থেকে শুরু করে অন্যান্য পূজাবার্ষিকী; সেই সঙ্গে সত্যজিৎ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, প্রফুল্ল রায়, প্রচেত গুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবী, শিবরাম চক্রবর্তীসহ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, ময়ূখ চৌধুরী, নারায়ণ দেবনাথের কমিকস; সন্দেশ থেকে ইন্দ্রজাল কমিকস্-এক অবর্ননীয় অনুভুতি, যা আজো হৃদয়ে দোলা দেয়!
সবচেয়ে অদ্ভুত হলো, আজো মনঘড়ি ঠিক জানান দেয় যে, পূজাবার্ষিকীর সময় চলে এসেছে! (এবার করোনা কারনে পূজাবার্ষিকী হাতে পৌঁছাতে একটু দেরী হয়েছে বৈকি তবু নতুন সংখ্যা হাতে নিলে আজো সেই শৈশব যেনো নেচে-গেয়ে ওঠে একান্ত সংগোপনে)।
ষষ্ঠীর ভোরে আমাদের পাড়ার কারিকর বিড়ি ফ্যাকটরীর পুজো মন্ডপে, সদর হাসপাতালের উল্টোদিকের পুজো মন্ডপে ঢাক বেজে উঠত একসঙ্গে। দুর্দান্ত ঢাকের অপূর্ব ছন্দের দুর্ধর্ষ ছন্দের জাদুতে পাগলপারা অবস্থা হতো, ভরদুপুরে ঢাকের শব্দে একধরনের অনুরণন তৈরী হতো মনে-এই অনুভুতির আসলেই কোনো ব্যাখা নেই!
ষষ্ঠী থেকে শুরু করে নবমী পর্যন্ত বিভিন্ন পাড়ার বিভিন্ন বয়সের কত-শত মানুষের সঙ্গে যে দেখা হয়েছে তখন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! মাইকে বাজতো হিন্দি আর বাংলা গান।
দুর্গাপুজোর একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকতো, সলিল চৌধুরির ওই গানটা- ‘আয়রে ছুটে আয়, পুজোর গন্ধ এসেছে’ টাইপ। ধুপের ধোঁয়া ওঠা মাটির পাত্র, নারকেলের ছোবড়ার মধ্যে সুগন্ধি আগুন, আরতী নৃত্য (ধুপের রহস্যময় ধোঁয়ার কুন্ডলির ভেতর মন আমার কতো যে নেচেছে ঢাকিদের ঢাকের প্রবল উস্কানিতে!)
দশমী চলে এলে ভীষণ দুঃখ হতো এই ভেবে যে—যাহ্! শেষ! আর কোনো উৎসবের আনন্দ রইল না! এখন পড়াশোনা করা আর মাঠে খেলা ছাড়া আর কিছুই করা হবে না! উৎসব বলতে যে আমেজ, সাজসজ্জা, জাঁকজমক, প্রাণের স্ফূরণ আর বিশালত্ব বোঝায়, তা সর্বজনীন দুর্গোৎসব ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানে ছিল কি?
আমরা, মানে যারা সনাতন ধর্মের কাঠামোর বাইরে, বিজয়ার দিনে বিসর্জনযাত্রায় যোগ দিতে কেউ আমাদেরকে কেউ কোনোদিন বারণ করে নি; বলেনি যে সনাতন ধর্মাবলমম্বীভিন্ন আর কেউ অংশ নিতে পারবে না! এমনকি, বিসর্জনের মুহুর্তে কে হিন্দু কে মুসলিম - এই ভাবনাই মাথায় আসতো না। ’দুর্গা মাই কি জয়’ বোল, ঢাক-উলুধ্বনি-শঙ্খনিনাদে চাপা পড়ে যেতো ধর্মের কল! একসাথে দাদা-ভাই-চাচা-কাকুরা যখন ‘দুর্গা মাই কি জয়’ নাজিরমহল্লার কাঠের পুলের খালে যখন ঝাপিয়ে পড়া, বড় হওয়ার পড়ে গনেশ ঠাকুরের জন্যে কাটপট্টি থেকে জোড়া ধুতি কেনা-কেনো যেনো সত্যি মনে হতো যে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’
আসলে পুজো মানেই আমার কাছে আস্টেপৃষ্টে মোড়া নস্টালজিয়া, যার পরতে পরতে আনন্দের নানা অনুভূতি। আমাদের শৈশব আজকের মতো ছিলো না তবে মনে হয় অনেক সমৃদ্ধ ছিলো।
এমন একটা অতি নিকট অতীত পেছনে রেখে, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কিছু লেখা যে কতটা হতাশার, সেটি বোঝানো যাবে না। যাদের সাথে জীবনের সবচেয়ে সোনালী অধ্যায় পার করেছি, ঈদ বা পুজো-যেখানে একাকার, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার নোংরামিতে তাদের সাথেই হানাহানিতে লিপ্ত হলাম? আর কোনোকিছু বলার ভাষা বা মুখ কোনোটাই রইলো না।
এ কথা সকলেই মানবেন যে, বাংলার সংস্কৃতিতে এই বাংলার লৌকিক দেবী দুর্গারই একমাত্র সর্বজনীন আবেদন রয়েছে। এই প্রাচীন জনপদের শাক্তধর্মের দুর্গাদেবীর সঙ্গে বাংলার কে পরিচিত নয়? সংস্কৃতিগতভাবে দুর্গাদেবীর আগমন সংক্রান্ত উৎসব উদযাপনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরেই অধিকার রয়েছে। শৈশব আর কৈশোরে তো আর এত-শত দার্শনিক বিষয়াদি বুঝতাম না তবে ঠিকই লক্ষ করতাম, আশপাশের সকলেই ষষ্ঠী থেকে শুরু করে বিজয়া দশমী পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
দেবী দুর্গা বাদে আর কোনো দেব-দেবীর বন্দনায় বিশাল, সর্বব্যাপি সর্বজনীন উৎসব আমরা দেখিনি; শিবঠাকুরের বন্দনাতেও নয়। যে কারণে বা যেভাবেই দুর্গোৎসবের প্রচলন হয়ে থাকুক না কেন, এটাই লক্ষণীয় যে, তাতে বরাবরই সর্বজনীনতার চর্চা হয়েছে।
এই সর্বজনীনতাই আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটা মস্ত বড় উদারতার দিক।
ক্ষমতার রদবদলের অপচেষ্টায় সেই পূজার আনন্দ বা ধর্মপালনের স্বাধীনতাকে দখল করার এমন চেষ্টা কেনো?
এতে কী ধর্ম অর্জন হচ্ছে-জানি না! আমরা পেছনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কোখায় যে গিয়ে ঠেকছি-তাও জানি না!
আমার শৈশবের কাছে আমিই লজ্জিত। আসলে আমরা মনের অপদেবতাকে বেড়ে উঠতে দিয়েছি। না পেরেছি শেকলে আটকাতে, না পেরেছি শিক্ষা দিতে।
পবিত্র ধর্ম ইসলাম কখনো সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করে না। পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে সার্বজনীন স্বীকৃত মদিনা সনদ বা Charter Of Madina বা সাহিফাত আল মাদিনাহ্। ১লা হিজরী সালে (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে প্রধান করে মদিনা রাস্ট্রের সকল সম্প্রদায় এই সনদ স্বাক্ষর করেন। ৪৭টি(মতান্তরে) ৫৩টি ধারার গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলোর মধ্যে অন্যতম:
-মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী মুসলমান, ইহুদী, খ্রিস্টান, পৌত্তলিকসহ সব সম্প্রদায় একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে এবং সব সম্প্রদায় সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।
-সব নাগরিক পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, “যারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগায় তারা আমার উম্মত নয়।”
যুগে যুগে ইসলাম শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। যারা সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে সমর্থন করে তারা ইসলামের শত্রু!
এছাড়া, মনে রাখতে হবে, আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেখানে অর্জিত হয়েছে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে, সেখানে বাংলাদেশে কখনো কখনো অপরাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়া হয়েছে, আজো ধর্ম নিরপেক্ষতাকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ধর্ম ব্যবসায়ী ও অপরাজনীতিবিদরা দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতা যারা নষ্ট করতে চায় সেসকল অপশক্তিকে বিনাশ করাই হোক আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার। যারা সাম্প্রদায়িকতার অপরাজনীতি করে, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতি করে তাদের বিনাশ হোক।
অনুধাবন করুন, সাম্প্রদায়িকতা ক্ষতি হবে আপনার-আমার, ফায়দা লুটবে অন্য কেউ। দয়া করে নিজেকে উগ্রদের হাতিয়ার বানাবেন না, সচেতন থাকুন সবাই।
দোয়া প্রার্থনা করি, মানুষের অন্তরের কলুষতা দূর হয়ে যাক; সকলের মঙ্গল কামনা করছি।

লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত

লেখকঃ সাবেক সহ-সম্পাদক , বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat