×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০৩-১০
  • ১৭৩৩ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক
"প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা- /কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি/ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়ঃ/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।।"
কিংবা "যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপান ভীম রণভূমে রনিবে না/বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত।"
সুকান্ত ও নজরুলের উপরোক্ত কবিতার সাথে পরিচয় নেই এমন সচেতন নাগরিকের সন্ধান পাওয়া বিরল।সুকান্ত ও নজরুল দ্রোহের কবি।তারা তাদের অজস্র লেখনির মাধ্যমে অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে মানুষকে উৎসাহ যুগিয়েছেন।উনাদের লেখায়ও এমন অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রভাব আছে যারা স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে কায়েমী শাসকগোষ্ঠী,পূঁজিপতি,সমাজপতিদের রোষানলে পড়েছেন।

ব্রিটিশ আমল ছিলো এমন দেশপ্রেমিক কবিদের জন্য স্বর্ণালি সময়।তারা অনেকেই জনগণের পালস বুঝতেন এবং নিজেও একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে কিছু করার তাড়না অনুভব করতেন।কিন্তু তারা স্বদেশীদের মতো হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নিতে পারতেন না।তাদের একটাই অস্ত্র ছিলো আর সেটা হচ্ছে 'শব্দ'।তাদের শব্দাস্ত্র ব্রহ্মাস্ত্রের মতো শাসকগোষ্ঠীর বুকে বিঁধতো।
মিল্টন বলেন,শব্দের নাকি ক্ষত সারিয়ে তোলার ক্ষমতা আছে।
পরবর্তীতে পাকিস্তান আমল কিংবা বাংলাদেশ উত্তর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এমন বিদ্রোহীদের দৃপ্ত পদচারণ দেখতে পেয়েছি সাহিত্যের জমিতে।তাদের ভয়ে শাসকগোষ্ঠী সর্বদা তটস্ত থাকতো।কিন্তু গত প্রায় তিন দশক ধরে আমরা আশ্চর্য্যজনকভাবে লক্ষ করছি,এমন কবি সাহিত্যিকদের বড়ই আকাল।আমাদের দেশের মানুষের বিদ্রোহের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য দেখে,সম্রাট হুমায়ুন গালভরে আমাদের দেশের নাম দিয়েছিলেন বুলগাকপুর বা বিদ্রোহের নগরী।এটার প্রমাণ যুগে যুগে আমাদের দেশের ছাত্র জনতা আবাল বৃদ্ধ বণিতা দিয়েছেন।কিন্তু এদেরই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট অংশ কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে গত তিন দশকে এ বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত।রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,সুকান্ত,জীবনানন্দের উত্তরসূরীদের এ বেহাল দশা আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করেছে।
আমার এ ক্ষুদ্র লেখায় অনেকটা জাবর কাটার মতো সে সকল কবি সাহিত্যিকদের কথাই আবার স্মরণ করিয়ে দিবো যারা দেশের আলো বাতাসে বেড়ে উঠার দাম চুকিয়েছেন তাদের রক্ত দিয়ে।তারা শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন।

অনেক কিছুই আজ অন্তর্জালের দুনিয়ায় ভাইরাল হয়।কিন্তু আজকে এদেশে কোন কবি বা তার কবিতা ভাইরাল হয়না।অথচ কিছুদিন আগে পাশের দেশ ভারতে দেখেছি সিএএ,এনআরসির বিরুদ্ধে তরুন কবি আমির আজিজকে বলতে,সবকুছ ইয়াদ রাখা যায়েগা....
পিংক ফ্লয়েডের প্রতিষ্ঠাতা গিটারিস্ট রজার ওয়েটার লন্ডনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে এ কবিতা পাঠ করলেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির দাবিতে যে সম্মেলন হয় সেখানে।আজকে আমির আজিজ সকল মুক্তিকামী জনতার মুখপাত্রে পরিণত হয়েছেন।আজকে সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে,"সবকুছ ইয়াদ রাখা যায়েগা.."
বিশ্বের বহু ভাষায় এটি অনুবাদ হয়েছে।
কিন্তু আমাদের এমন মুখপাত্র কোথায়!

ব্রিটিশ মহিলা কবি ডেব্রাহ আলমা যিনি কবিতার ফার্মেসি খুলেছেন।রোগীদের মানসিক অবস্থা বুঝে তিনি পথ্য হিসেবে কবিতা দিয়ে থাকেন।ঘুমের ঔষধ,ভিটামিন ট্যাবলেটের বদলে তিনি ঔষধ হিসেবে কবিতা দেন।আর এতে রোগীরা সুস্থ হচ্ছেন।সারাদেশে ছয় বছর ধরে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরে ঘুরে এ কবিতা ঔষুধ বিলিয়ে যাচ্ছেন।এ জন্য তিনি যুক্তরাজ্যে 'ইমার্জেন্সি পোয়েট' নামে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
আমাদের কবিতার ডাক্তাররা কোথায়?

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্থ-সামাজিক অবস্থার মতো কবিতার শরীরও পাল্টাতে শুরু করে।পাতা,ফুল,প্রেম,পাহাড়,সমুদ্র,চাঁদ,তারা,আকাশ এসবের জায়গায় নাগরিক যন্ত্রণা,আমাদের চাহিদা,বেঁচে থাকার স্ট্রাগল,যুক্তি,একাকিত্ব,যৌনতা,প্রতিবাদ এসব হয় কবিতার বিষয়।২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার প্রতিবাদের কবিতা লেখা হয়েছে।যুদ্ধ,হানাহানি,ধর্ষন,রাজনীতি ইত্যাদির প্রতিবাদে বহুক্ষেত্রে কবিতা হয়ে উঠেছে হাতিয়ার।
কিন্তু এখনকার কবিরা আবারও পিছনে ফিরতে শুরু করেছেন।তারা ফুল,ফল,প্রেম এসব নিয়ে মেতে উঠেছেন।বলছিনা এসবের দরকার নেই কিন্তু আবারও সুকান্তকে টানতে হয়,"ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।।

আজকে কবিদের গায়ে ট্যাগ লেগেছে কেউ সরকারদলীয়,কেউ বিরোধীদলীয়।অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদও এ যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।হালের প্রধান কবিদের গায়েও এ ধরণের ট্যাগ লেগে আছে।কিন্তু "জনগণের কবি" এ ট্যাগ তাদের গায়ে লাগেনাই।আফসোস!

সবাইকে পড়তে হয়।কবি সাহিত্যিকদের আরও বেশি পড়তে হয়।রবীন্দ্রনাথ নজরুলও প্রচুর পড়েছেন।ঘটে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বুদ্ধি যেমন জরুরি তেমনি জরুরি বিদ্যার আর যা আসে চর্চার মাধ্যমেই।হালের কবি সাহিত্যিকরা ম্যাক্সিম গোর্কি,নিকোলাই অস্ত্রভস্কি,জোসেফ কনরাড,পাবলো নেরুদা,বরিস পাস্তেরনাক,ই এম ফস্টার,ডব্লিউ বি ইয়েটস, মায়াকোভস্কি,লুঁই আরাগঁ,পল এলুয়ার,কুয়ো মোজো,নাজিম হিকমত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজদের না পড়েন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,সুকান্ত,হেলাল হাফিজদের পড়তে পারেন।কথায় আছে,দেশের সীমান্ত আছে কবির সীমান্ত নেই।

যেমন প্যালেস্টাইনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ তার মধ্যপ্রাচ্যের সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের প্রাচ্যের সীমান্তে করাঘাত করেন।দখলদারদের খেদিয়ে নিয়ে আসেন সীমান্তের পর সীমান্ত।তিনি তার বিখ্যাত 'পরিচয়পত্র' কবিতায় নিজের পরিচয় দেন এভাবে-
"লিখে রাখুন
আমি একজন আরব
আপনি চুরি করে নিয়েছেন আমার পূর্বপুরুষদের ফলের বাগান
এবং আমার জমিজায়গা যেখানে আমি আমার
সন্তানদের সাথে
চাষবাস করতাম
এবং আপনি আমার জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি
কেবল পাহাড়গুলো ছাড়া
সুতরাং লিখে রাখুন প্রথম পৃষ্ঠার উপর 
আমি মানুষকে ঘৃণা করিনা
সীমা লঙ্ঘনকারীও আমি নই।
কিন্তু আমি যদি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি
দখলকারীর মাংসই হবে আমার খাদ্য।
সাবধান...সাবধান হয়ে যান
আমার খিদে এবং আমার ক্রোধের ব্যাপারে।"
মাহমুদ দারবিশের এক একটি কবিতা যেন এক একটি মহা বিস্ফোরণ।

 একজন আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ সশরীরে সীমান্ত পেরিয়ে এসে পরাক্রমশালী পাক হানাদার বাহিনীকে নাঙা করে দেন শব্দবোমা দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেন।লিখেন "সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড"।তিনি ছিলেন তৎকালীন পূঁজিবাদী বিশ্বের আতঙ্ক।

বিখ্যাত বিপ্লবী কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যেদিন স্বাধীন হয় সে দিবসটিও চাক্ষুষ দেখেন।তিনি "অ্যা গ্রেট ডে" কবিতায় লিখেন,
"বিপ্লব ও কামানের গোলা জিন্দাবাদ
ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা এক ভিক্ষুক
বেত্রাঘাত করছে আরেক ভিক্ষুককে
বিপ্লব ও কামানের গোলা জিন্দাবাদ।
ভিক্ষুকের স্থান বদল হয়েছে
কিন্তু বেত্রাঘাত চলছেই।"
এভাবেই তিনি আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা পরবর্তী অরাজকতাকে তুলে ধরেন।

উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ আরেক মহীরুহ।তিনি আজীবন সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছেন।১৯৫১ সালে,"এই দাগ ভোরের আলো, এই রাতের খাপে ঢাকা ভোর " কবিতার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৯৫১-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন।১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান তাকে আবারও জেলে পাঠায়।১৯৮৪ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য শর্ট লিস্টে তাঁর নাম মনোনীত হয়।কিন্তু বন্ধু প্যালেস্টাইনের ইয়াসির আরাফাতের অনুরোধে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন।সেটাও একটা প্রতিবাদ।১৯৭১ সালে তিনি আমাদের পক্ষে,"বাংলাদেশ ২" নামক কবিতায় লেখেন,
"প্রতিটা গাছ রক্তের মিনারের মতো
প্রতিটা ফুলও রক্তমাখা
প্রতিটি চাহনি যেন বর্শার তীর।"
তিনি জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে লিখেছিলেন,
"একদিন তোদের আমরা দেখে নেবো
তোদের আমরা অবশ্যই দেখে নিবো....
যেদিন জুলুম আর বেইনসাফির হিমালয়
তুলার মতো ফরফর উড়ে যাবে তুফানে
মজলুমের পায়ের তলায়।
ধরিত্রী কাঁপবে থর থর থর থর আর থর থর
আর ক্ষমতাওয়ালাদের মাথার উপর
বিজলী ও বিদ্যুৎ চমকাতে থাকবে কড় কড় আর কড় কড়
আমরা তোদের দেখে নিবো।"
তার এ গীতিকবিতা এক বছর আগের ভারতের সিএএ আন্দোলনে পঠিত হয়েছে।

এবার নিজের ভূমন্ডলের একাল সেকালে ফেরা যাক।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত(১৮২৪-১৮৭৩)-
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক বিপ্লবী।"মেঘনাদ বধ" কাব্যের মধ্যেই তিনি বিদ্রোহের গোপন আগুন জ্বালিয়ে দেন।রাবনপুত্র মেঘনাদ একজন দেশপ্রেমিক বীরযোদ্ধা আর রামকে এখানে পরদেশ আক্রমনকারী ইংরেজ হিসেবে তুলে ধরেন।মধুসূদনের এ প্রতীকী ব্যবহার তার স্বাধীনতার 
স্পৃহাকে তুলে ধরে।তাইতো মেঘনাদ বধ কাব্যে রাবন বুক চিতিয়ে বলে,"জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে"।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১)
তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেন ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করেন।তবে তিনি অন্ধ বিপ্লবের বিরোধিতা করেন।তিনি ভারতীয়দের সমস্ত উপযোগমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেন।এ ধরণের মতবাদ অনেককে বিক্ষুব্ধ করেছিল।এমনকি ১৯১৬ সালের দিকে একদল ভারতীয় চরমপন্থী রবীন্দ্রনাথকে সানফ্রান্সিসকোর হোটেলে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।কিন্তু নিজেদের মতবিরোধের কারণে এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা,গান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৯ সালে জালিআনওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দেয়া নাইটহুড উপাধি বর্জন করেন।লর্ড চেমসফোর্ডকে তিনি লিখলেন-"আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।"
রবীন্দ্রনাথের কবিতা,"চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য" ও গান "একলা চলো রে" রাজনৈতিক রচনা হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়।"একলা চলোরে" গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিলো।রবীন্দ্রনাথ দুর্বল মুখস্তসর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লেখেন,"তোতাকাহিনী" গল্প।এমনকি নিজে ভিন্ন ধারার বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বভারতী'।

নজরুল ইসলাম(১৮৯৯-১৯৭৬)
১৯২০ সালে মোসলেম ভারত ও বিজলী পত্রিকায় একযোগে 'বিদ্রোহী' প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যজগতে এক শক্তিমান কবির আবির্ভাব হয়।উনার লেখার প্রতিপাদ্য বিষয়-সাম্য,দেশপ্রেম,উৎপীড়িত মানব মনের ব্যাথা,মানবিক প্রেম,বিরহ,অসাম্প্রদায়িক চেতনা সর্বোপরি সকল অন্যায় আর গ্লানির বিরুদ্ধে তীব্রকন্ঠ প্রতিবাদ।এ জন্য তিনি কারাভোগও করেছেন।তার দেশাত্ববোধক গানগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছে।নানা গুনের সমাহার হলেও তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবেই খ্যাতিমান।তখন গান্ধীজীর নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন,বেঙ্গল প্যাক্ট,সাইমন কমিশন,নেহেরু রিপোর্ট আবার পাশাপাশি রুশ বিপ্লব,প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় বিপর্যয় সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে চলছিল এক নিদারুন মানবিক অস্থিরতার লড়াই।এ সময়ই আপোসহীন মানুষের মাঝে বিদ্রোহের মন্ত্র নিয়ে ধুমকেতুর মতো এক বাবড়ি দোলানো কবির আবির্ভাব হয়।'বিদ্রোহী' প্রকাশিত হলে আগুনের গোলার মতো ছড়িয়ে পড়লো বাংলার সর্বত্র।সবার মুখে তখন একই জপমালা,"আপনারে ছাড়া কাহারে করিনা কুর্নিস "
একে একে নজরুলের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়।১৯২২ সালে বাংলা ফৌজদারি বিধির ৯৯ এ ধারায় সরকার নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যুগবানী' নিষিদ্ধ করে।১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ হয় 'বিষের বাঁশি'।তবে নিষিদ্ধ করেও এটির প্রচার বন্ধ রাখা যায়নি।বইটি উপরের মলাট ছাড়াই কলকাতার বিভিন্ন প্রেস থেকে ছাপা হতে থাকে।সবার পকেটেই তখন বিষের বাঁশি।এর কিছুদিন পরই নিষিদ্ধ হয় "ভাঙার গান"।বইটি বাজেয়াপ্ত হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর।১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নিষিদ্ধ হয় "প্রলয় শিখা"।তবে এবার সরকার শুধু নিষেধাজ্ঞায় সীমাবদ্ধ ছিলোনা।তারা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ৬ মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করে।১৯৩১ সালে নিষিদ্ধ হয় ব্যঙ্গাত্মক কাব্যগ্রন্থ "চন্দ্রবিন্দু"।এ গ্রন্থটি ছিলো ব্রিটিশদের পা চাটা দেশি সাহেবদের প্রতি বিদ্রুপ করে।এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের প্রতি সরকারের আক্রোশ ছিলো।অগ্নিবীনা,সঞ্চিতা,ফনিমনসা,সর্বহারা,রুদ্রমঙ্গল ইত্যাদি গ্রন্থেও বিপ্লবের ঘ্রান পেয়েছিল সরকার।অল্পের জন্য এগুলো বাজেয়াপ্তের হাত থেকে বেঁচে যায়।মোট দুটি গ্রন্থের জন্য নজরুল ইসলাম কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন।আগেই প্রলয়শিখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।দ্বিতীয়বার কবি দন্ডিত হন তার সম্পাদিত 'ধুমকেতুতে ১৯২২ এর ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত "আনন্দময়ীর আগমনে" কবিতার জন্য।কবিতাটি ছাপার জন্য কবিকে ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪ এ ধারা অনুসারে ১ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়।নজরুলকে প্রথম প্রেসিডেন্সি জেলে নেয়া হয় এরপর কারাদন্ডের পর তাকে আলিপুর জেলে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়।এ জেলে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ তাঁর "বসন্ত" নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন।এখানে নজরুল নানা অনিয়ম অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমরণ অনশন শুরু করলে তাকে হুগলি জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়।বাংলার মানুষ তাঁর মুক্তির জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।রবীন্দ্রনাথ তার অনশন ভাঙ্গার জন্য জরুরি চিঠি পাঠান-"গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক,আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।"
অনশন ভাঙ্গার পর তাকে বহরমপুর কারাগারে পাঠানো হয়।শিকল পড়েই কবি শিকল ভাঙ্গার গান বাঁধলেন।
"শিকল পরা ছল মোদের শিকল পরা ছল/এ শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।"
কলকাতার জেল থেকে হুগলির জেলে কবিকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে আনা হয়েছিল।

সুকান্ত ভট্টাচার্য(১৯২৬-১৯৪৭)
নজরুলের মতো তিনিও একজন জাত বিপ্লবী।"আগামী","একটি মোরগের কাহিনী","সিগারেট","দেশলাই কাঠি","আঠার বছর","হে মহাজীবন" প্রভৃতি চমৎকার কবিতা।এসবের পরতে পরতে লুকানো বিপ্লবের আহবান।
তিনি বলেন,"জড় নই মৃত নই নই অন্ধকারের খনিজ/আমিতো জীবন্ত প্রাণ আমি এক অঙ্কুরিত বীজ।"
একটি মোরগের কাহিনীতে তিনি পূঁজিবাদের,সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন রুপ তুলে ধরেন এবং সবাইকে সাবধান করেন।
"অসহায় মোরগ বারবার চেষ্টা করলো  প্রাসাদে ঢুকতে
প্রত্যেকবারই তাড়া খেলো প্রচন্ড
তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল
একেবারে সোজা চলে এল
ধবধবে সাদা দামি কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে
অবশ্য খাবার খেতে নয়
খাবার হিসেবে।"

হেলাল হাফিজ(১৯৪৮-)
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একজন দ্রোহের মানবিকতার কবি হিসেবে হেলাল হাফিজ অগ্রগণ্য।তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।তিনি তার 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' কবিতায় বলেন,
"কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছিনা।"
তিনি আরও বলেন,"এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়"
"নিউট্রন বোমা বুঝো
মানুষ বুঝো না।"
তার "যে জলে আগুন জ্বলে" যে কোন বিপ্লবীর বুকে আগুন জ্বলাতে যথেষ্ট।

দ্রোহের কবি ও কবিতা আলোচনা করলে পঞ্চাশের দশকের দুজন কবির নাম আসবেই।ফররুখ আহমেদ(১৯১৮-১৯৭৪) ও সুভাস মুখোপাধ্যায়(১৯১৯-২০০৩)
ফররুখের কবিতা "লাশ" বিপ্লবী সাহিত্যে এপিক।
সুভাস মুখোপাধ্যায় পুঁজিবাদী কায়েমী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কবিতা দিয়ে বুকচিতিয়ে লড়েছেন।তিনি তার মে দিনের কবিতায় বলেন,
"প্রিয়,ফুল খেলার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের সেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।"

শঙখ ঘোষের কথা বলা যায়,তিনি তার "ধ্বংস করো ধ্বজা" কবিতায় বলেন,
"আমি বলতে চাই নিপাত যাও
এখনই
বলতে চাই চুপ
তবু বলতে পারিনা।আর তাই
নিজেকে ছিঁড়ে ফেলি দিনের পর দিন।তিনি বিশ্বাস করেন,"যে কবি সমাজের সত্য ও মিথ্যাচার বলতে বা লিখতে পারেনা তার কবি হিসেবে অনেক আগেই মৃত্যু ঘটে গেছে।"

নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও আমরা ব্যাপকভাবে দেখেছি রাজনীতির মাঠে কবিদের পদচারণা।তারা তাদের ব্রহ্মাস্ত্র কবিতা দিয়ে শাসকদের বুক এফোড়ওফোড় করে দিয়েছেন।স্বৈরাচারী এরশাদের পতনে কবি ও কবিতার ব্যাপক অবদান ছিলো।বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মতোই আমরা দেখেছি চোরাকবি এরশাদের আবির্ভাব।এরশাদ কবি ও কবিতাকে এত বেশি ভয় পেতেন নিজেই কবিতা কিনে নিজের নামে ছাপিয়ে কবি সেজে যান।তিনি কবিদের একতায় ফাঁটল ধরানোর চেষ্টা করেন।
কিন্তু তার সমস্ত অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান কবিরা।যেমনটা পাকিস্তানে সামরিক শাসক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ।এখানে কবি শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে কবিরা সংগঠিত হোন।
১৯৮৭ সালে শামসুর রাহমানকে সভাপতি ও কবি মোহাম্মদ রফিককে সাধারণ সম্পাদক করে জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এ সেই কবি মোহাম্মদ রফিক যিনি এরশাদের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন,
"সব শালা কবি হবে,
পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই
দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই।"
প্রথম কবিতা উৎসবের শ্লোগানই ছিলো,"শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা"
১৯৮৮ সালের জাতীয় কবিতা উৎসব ছিলো আরও আগ্রাসী।এর শ্লোগান ছিলো,"স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা"।
এ উৎসব মঞ্চে অতিথি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিল্পী কামরুল হাসান।তিনি এখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।মারা যাওয়ার আগে একটা স্কেচ একে দিয়ে এর নিচে লিখেন,"দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে।"

কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেশে রাজনৈতিক ইস্যুর অভাব ছিলোনা।কিন্তু অতীতের শব্দসৈনিকদের মতো আর তাদের উত্তরসূরীদের এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।তারা কুম্ভকর্ণের মতো লম্বা ঘুম দিয়েছেন।গত ৩ দশকের এ ঘুম যেন ভাঙ্গার নয় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে।

অথচ পাশের দেশ ভারতের আসামে সম্প্রতি কবিতায় বঞ্চনার ব্যাথা উচ্চারণের জন্য তরুন কবি হাফিজ আহমদসহ ১০ কবিকে গ্রেফতার করা হয়।পশ্চিমবঙ্গের কবি শ্রীজাতের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কবিতার একটি শব্দের কারণে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের লেখকরা তাদের পুরস্কার বর্জন করেন গো হত্যার অভিযোগে মানুষ পিটিয়ে মারার প্রতিবাদে।

লেখাটি শেষ করতে চাই,রুশ কবি ওপিস মান্দেলস্টামের প্রসঙ্গ টেনে।তিনি স্টালিনের আমলে ১৯৩৩ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জেল খাটেন।ওপিসের স্ত্রী নাজেজদা ছিলেন নাইট শিফটের শ্রমিক।তিনি কাজ করতেন আর বিড়বিড় করে আওড়াতেন ওপিসের কবিতা যেন তা হারিয়ে না যায়,যেন আবার লেখা যায়।তার কবিতা হারিয়ে যায়নি বরং সংগ্রামের নতুন শিখা জ্বালিয়েছে।

তথ্যসূত্রঃ
ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই
-শিশির কর।;
কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা-মুজাফফর আহমেদ।
;শঙ্খ ঘোষের কবিতায় প্রতিবাদ- এক উজ্জল উদ্ভাস
-সৈকত ঘোষ।;
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও কবির লড়াই
-মুসা আল হাফিজ;
কবিতায় দ্রোহ,প্রতিবাদ ও মানবিকতা
-সায়ীদ আবুবকর।;
হেলাল হাফিজ:দ্রোহী প্রেমিক,বিনীত বিদ্রোহী
-মোহাম্মদ নুরুল হক।;
দেশ রুপান্তর পত্রিকা।;
উইকিপিডিয়া।;
বিবিসি বাংলা।

লেখক:মনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া পুলক
প্রভাষক, সরকারি রোটারী কলেজ, অষ্টগ্রাম, কিশোরগন্জ।
১০ মার্চ,২০২১ খ্রিষ্টাব্দ,

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat