×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০৩-০৭
  • ২৩১১ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য অবদান। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন- এই দীর্ঘ বন্ধুর পথে তার অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সঠিক দিক-নির্দেশনা জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, '... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।'

মূলত এটাই ছিল স্বাধীনতার ডাক। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে তাই ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ৯ মাস পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে থাকলেও সর্বক্ষণ বাংলার মানুষের সঙ্গে ছিলেন। তার বজ্রকণ্ঠের বক্তৃতায় রক্ত টগবগিয়ে উঠত এ দেশের মানুষের। তাই তো শতকষ্টের মাঝেও জীবন দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছেন তারা। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষণটিকে 'মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার'-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করছে সরকার। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দিবসটি উদযাপনে অনুষ্ঠানমালা কিছুটা সীমিত করলেও বিভিন্ন আঙ্গিকে তা উদযাপন করা হচ্ছে।

১৯৭১-এর ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রস্তুতি হিসেবে পূর্বাণী হোটেলে ১ মার্চ আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হয়। ওই সময় রেডিওতে ঘোষিত হয়- প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। শাসক শ্রেণির স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে বাংলাদেশের মানুষ আগেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রেডিওতে ইয়াহিয়ার এই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে দলমত-নির্বিশেষে জনগণ রাজপথে নেমে পড়ে। তাদের 'তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'পিন্ডি না ঢাকা/ ঢাকা ঢাকা' ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে পুরো ঢাকা শহর। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ছয় দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তা হচ্ছে ২ মার্চ ঢাকায় পূর্ণ হরতাল ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল।

বঙ্গবন্ধু আরও ঘোষণা দেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় ভাষণ দেবেন। দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু এও বলেন, ভুট্টোর দল ও কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগ ছাড়াও আমরা শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারব। একই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়, ৭ মার্চের জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এমন প্রেক্ষাপটে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর সেরা রাজনৈতিক ভাষণের ইতিহাসে তার এই ভাষণ ব্যতিক্রমী এবং অনন্য। অন্যসব সেরা ভাষণ ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি অলিখিত। তিনি স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে তার মনের কথা জনতার উদ্দেশে বলেছেন। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণ শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন জনতাকে 'আপনি' সম্বোধন করে। বলেছিলেন, 'আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।' তিনি জনতাকে তার সহযাত্রী মনে করেছিলেন। সহযাত্রীর সব দুঃখ-বেদনা সম্পর্কে তিনি ছিলেন ওয়াকিবহাল। প্রকৃত নেতারা এমনই; যেমনটা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণের এক পর্যায়ে বাংলার আপামর জনসাধারণের অনুভূতিকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে ঝালিয়ে নিয়ে কখন যে উপস্থিত জনতা 'আপনি' থেকে 'তুমি'তে পরিণত হয়েছে, তা বক্তা-শ্রোতা কেউ-ই খেয়াল করেননি। বঙ্গবন্ধু বলেন, '... তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। ...মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্‌।' এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান একটি গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।

ষাটের দশকের শেষদিকে পৃথিবীর অনেক দেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছিল। নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতার জন্য বায়াফ্রা সশস্ত্র সংগ্রাম করছিলেন। আন্দোলন চলছিল ইন্দোনেশিয়াতেও। সেসব আন্দোলনের নেতিবাচক দিক ও দুর্বলতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল। তিনি উপলব্ধি করেন, হঠকারিতার পরিণতি শুভ হয় না এবং হঠকারী নেতা কখনও বিশ্ববাসীর সমর্থন পান না। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে সাবলীল বক্তৃতা করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রতিদিন যে মানুষ মারা যাচ্ছিল, তাও তুলে ধরেন তিনি। ২৫ মার্চে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের কথাও উঠে আসে তার ভাষণে। তুলে ধরেন পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনীতির পটভূমি। বঙ্গবন্ধু বলেন, '২৫ তারিখে অ্যাসেমব্লি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই।... শহীদদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।... আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। ...আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।'

বঙ্গবন্ধু তার ঘোরতর প্রতিপক্ষ ও শত্রুকেও সৌজন্য রক্ষা করে সম্বোধন করেছেন। তিনি বলেন, 'জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব', 'ভুট্টো সাহেব।' তিনি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং জাতীয় পরিষদে যোগদানের এমন চারটি শর্ত ঘোষণা করেন, যা কারও পক্ষে অযৌক্তিক বলা সম্ভব ছিল না।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। ৭ মার্চের পরও তিনি ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। তারা চেয়েছেন অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বারণ করে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছেন, 'তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।'

আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি। উদযাপন করেছি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। এ বছর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেরও ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এই ভাষণটি আজও আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা।

উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর।
vcbsfmstu@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat