×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০৩-০৬
  • ৮৫৯ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

২৮ ফেব্রুয়ারি বেলা সোয়া একটা। শ্যামলীর কলেজ গেট বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রী তুলে ৮ নম্বর রুটের (গাবতলী-যাত্রাবাড়ী) বাসটি চলতে শুরু করতেই চারদিক কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো অন্য যাত্রী, পথচারীরা হাত দিয়ে কোনোরকমে চোখমুখ ঢাকলেন। এখন রাজধানীর বিভিন্ন পথে চলা বেশির ভাগ বাসই কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলছে কার্যকর নজরদারি না থাকার সুযোগে।

মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত হলে তা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু রাজধানীর সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কালো ধোঁয়া ছড়ানো যানবাহন। একসময় কালো ধোঁয়া বন্ধে নিয়মিত অভিযান চলত। গত বছরের মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়া পর থেকে অভিযান হয় না বললেই চলে।

যানবাহনের কালো ধোঁয়া বন্ধের বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব পরিবেশে অধিদপ্তরের। আর যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। কিন্তু যানবাহনের কালো ধোঁয়ার দূষণের মাত্রা পরিমাপ করার মতো কোনো যন্ত্র বিআরটিএর কাছে নেই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিবেশ সার্কেল থাকলেও কালো ধোঁয়া বন্ধে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। ঢাকা মহানগর পুলিশেরও কালো ধোঁয়ার দূষণের মাত্রা পরিমাপের কোনো যন্ত্র নেই।

শ্যামলীর কলেজ গেট বাসস্ট্যান্ডে ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে ছিল। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন তিনি। সাহাবুদ্দিন বললেন, ‘অনেক গাড়ি থেকেই কালো ধোঁয়া বের হতে দেখি। এগুলো কতটা খারাপ, তা বলতে পারব না। এগুলো দেখা কারও না কারও তো দায়িত্ব।’

বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীতে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১৬ লাখ ৫২  হাজার ৩২৩টি। এর মধ্যে বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৫০টি। ট্রাকের সংখ্যা ৭৪ হাজার ৩৩০টি। আর মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৮ লাখ ৯ হাজার ১৮৯টি। গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ঘুরে দেখা যায়, পুরোনো ও লক্কড়ঝক্কড় বাস থেকে কালো ধোঁয়া বেশি নির্গত হয়। রাতে চলাচলকারী ট্রাক থেকেও কালো ধোঁয়া নির্গত হয়।

ঢাকা মহানগর পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, কালো ধোঁয়া বন্ধে সমিতির পক্ষ থেকে পরিবহনমালিকদের সঙ্গে সভা করা হয়েছে এবং চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারপরও কোনো মালিক এমন যানবাহন রাস্তায় নামালে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

মূলত ফিটনেসবিহীন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া বেশি ছড়ায়। যানবাহনের ফিটনেস সনদ দিয়ে থাকে বিআরটিএ। সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, কালো ধোঁয়ার বিষয়টি কারিগরি, এটি খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। বিআরটিএর কাছে কালো ধোঁয়া পরিমাপের যন্ত্র নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে ধোঁয়া পরিমাপের যন্ত্র নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। কালো ধোঁয়া ছড়ায় এমন যানবাহন সড়কে না নামাতে পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ ইউনিটের গবেষণার গত বছরের জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীর ৫০ শতাংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধোঁয়া এর জন্য দায়ী। গত এক যুগ ধরে ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে ইটভাটাকে মনে করা হতো।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুন থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে যানবাহনের কালো ধোঁয়ার বিরুদ্ধে ৩৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া ছড়ানোয় বিভিন্ন যানবাহনকে ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) রুবিনা ফেরদৌসী বলেন, যানবাহনের কালো ধোঁয়া বন্ধে ভবিষ্যতে এমন অভিযান আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন

কালো ধোঁয়ার সঙ্গে সূক্ষ্ম বস্তুকণা, সালফার ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, সিসাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, কালো ধোঁয়ায় বিষাক্ত উপাদানের প্রভাবে ফুসফুস ও কিডনির জটিলতা এবং হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া কালো ধোঁয়ার সংস্পর্শে এলে শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তি ব্যাহত হয়।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব পরিবেশ সার্কেল রয়েছে। তবে যানবাহনের ধোঁয়া দূষণ বন্ধে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ধোঁয়া বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধা নেই। কিন্তু সিটি করপোরেশনের ধোঁয়া পরিমাপের কোনো যন্ত্র নেই।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন
corporation

আর উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিবেশ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তারিক বিন ইউসুফ বলেন, কালো ধোঁয়া বন্ধের দায়িত্ব বিআরটিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের।
আইন অনুযায়ী, যানবাহনের কালো ধোঁয়া বন্ধের দায়িত্ব পুলিশেরও। পুলিশ মাঝেমধ্যে কালো ধোঁয়া ছড়ানোয় যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মনিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কালো ধোঁয়া ছড়ানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। যখনই কোনো যানবাহনকে অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া ছড়াতে চোখে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলা যান জব্দ করাসহ বায়ু দূষণ রোধে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ৯ দফা নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এরপর গত ২৪ নভেম্বর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা এক রিটের ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট এসব নির্দেশনা দেন।

এইচআরপিবির সভাপতি ও আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, কালো ধোঁয়া বন্ধে নির্দেশনা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর গাফিলতির কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো চোখ-কান ভালোভাবে না খুললে এমন অবস্থা চলতেই থাকবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat