×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০১-০৩
  • ২১৬৪ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, সময়ের দাবিতেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মলগ্ন থেকেই ভাষার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ছাত্র সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অতিক্রম করেছে পথ চলার ৭৩ বছর।

ছাত্রলীগ সম্পর্কে গর্ব করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস, ছাত্রলীগের ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস।' বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের যথার্থতার প্রমাণ মেলে সংগঠনটির স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে। বাংলা ও বাঙালির যা কিছু সোনালী অর্জন তার সবকিছুরই গর্বিত অংশীদার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাঙালি জাতির ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় ও অর্জনে রয়েছে ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ ভূমিকা।

প্রতিষ্ঠার পরই মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রক্তাক্ত ও সংগ্রামী অভিযাত্রার শুরু, এর পর থেকে প্রতিটি ন্যায্য আন্দোলন-সংগ্রামের সম্মুখ সমরের যোদ্ধা ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশান উড়ানোর নেপথ্যের কারিগরও ছিলো ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়, ১৯৫৭ এর শিক্ষক ধর্মঘট এবং ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলনেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এই সংগঠন। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা বাস্তবায়নে শেখ মুজিবুর রহমান আস্থা রেখেছিলেন তরুণ ছাত্রনেতাদের ওপর। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছিল রাজপথের প্রমিথিউস। ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই ঊনসত্তরের আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিদায় ঘন্টাও বাজিয়ে দেয় ছাত্রলীগ। পাকিস্তান সামরিক শাসকেরা বাধ্য হয়ে জেল থেকে মুক্তি দেয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু উপাধি। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭১ সাল, উত্তাল দেশ। পাকিস্তানি শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাংলার মানুষ। চারদিকে তখন শুধুই মুক্তির জন্য মানুষের হাহাকার। ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ায় পরদিন সকাল থেকেই দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ঢাকার রাজপথে অবস্থান নেয়, ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুম, নিগ্রহ, শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ জড়ো হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বেলা ১১টার দিকে ডাকসুর নেতারা যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন নগর ছাত্রলীগ নেতা শেখ জাহিদ হোসেন একটি বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে মিছিল সহকারে মঞ্চের দিকে আসেন। এই পতাকা নিয়ে ডাকসু নেতারা উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা ,অকুতোভয় ছাত্রসমাজ ও জনতা পাকিস্তানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জানিয়ে দেয় বাঙালিরা মাথা নত করবে না। সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে বুঝি বাঙালি ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়।
৭ মার্চ, সময়ের পরিক্রমায় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলার মানুষের প্রাণ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।“ ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই ছাত্রলীগ নেতারা সারাদেশে মুক্তি সংগ্রামের জন্য সংঘটিত হতে থাকে। ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকেরা এক বর্বর অধ্যায়ের রচনা করে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত ঘোষণা দিলে ছাত্রলীগ নেতারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের ১৭ হাজার বীর যোদ্ধা তাদের বুকের তাজা রক্তে এঁকেছেন লাল-সবুজের পতাকা, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক সার্বভৌম মানচিত্র। যে মানচিত্রের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে লেগে আছে ছাত্রলীগের বীর শহীদের রক্ত।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পর সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশের পুনর্গঠনের সংগ্রামেও ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়। বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের ইতিহাসে একজন অনন্য সংবেদনশীল নেতা যিনি জাতির প্রাণের স্পন্দন টের পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও পরাজিত শক্তি ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। এরপরে এদেশে চরমভাবে ইতিহাস বিকৃতি হতে থাকে। থমকে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশ। পরাজিত শক্তি ও তাদের এদেশীয় দোসররা বাংলার মানুষদের নিয়ে শুরু করে নারকীয় খেলা। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ বাংলাদেশকে মুক্তি দিতে জীবন বাজি রেখে ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সেদিন প্রিয় নেত্রীর পাশে ভ্যানগার্ডের ভূমিকায় ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সম্মুখ সমরে ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ছাত্রলীগ সবসময় বুক চিতিয়ে লড়েছে। রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বিতর্কিত সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আটক আমাদের প্রিয় নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনে প্রথম সাহসী উচ্চারণ তুলেছিলো বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগের কর্মীরাই।

৭৩ বছরের পথ চলায় বাংলা ও বাঙালির প্রতিটি ন্যায্য আন্দোলনে ছাত্রলীগ সর্বদা সক্রিয়। যখনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত এসেছে তখনি ছাত্রলীগ প্রতিবাদ, প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তুলেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশের প্রতিটি দুর্দিন দুর্বিপাকে সম্মুখ সমরে থেকে কাজ করেছে ছাত্রলীগ। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি মোকাবেলায় বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পালন করেছে অগ্রণী ভূমিকা। সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রী তৈরি ও মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া কাজটি করেছে ও করে যাচ্ছে ছাত্রলীগের কর্মীরাই। অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটানো, গরিব কৃষকের ধান কেটে বাড়ি পৌঁছে দেয়াসহ ছাত্রলীগের নানা সেবা মূলক কার্যক্রম প্রশংসীত হয়েছে সর্বমহলে।
বিদ্যার সঙ্গে বিনয়, শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা, কর্মের সঙ্গে নিষ্ঠা এবং জীবনের সঙ্গে দেশপ্রেম এর সংমিশ্রণ আর কর্তব্যপরায়ণের সঙ্গে ছাত্রলীগ অতিক্রম করেছে দীর্ঘ ৭৩ বছর। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এগিয়ে যাচ্ছে। তারা যুগে যুগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়বে শিক্ষা শান্তি প্রগতির মশাল হাতে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থাকবে অমর অক্ষয় হয়ে।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক - সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat